বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেবতা হলেন তিরুপতি বালাজি। তেলেগু ভাষায় ‘তিরু’ কথার অর্থ শ্রী বা লক্ষ্মী, অর্থাৎ লক্ষ্মীর পতি বা তিরুপতি। অনেকে তাঁকে গোবিন্দা, বিষ্ণু, লর্ড বালাজি কিংবা লর্ড ভেঙ্কটেশ নামে ডেকে থাকেন। এখানে ভক্তি, বিশ্বাস আর মনোরম প্রকৃতির এক অপরূপ মেলবন্ধন দেখা যায়। বালাজির কাছে কিছু মানত করলে তা পূরণ হয় বলে মানুষের বিশ্বাস। তাইতো হতদরিদ্র থেকে ক্রোড়পতি, মেগাস্টার, রাজনীতিবিদ, দেশের বাইরের কূটনীতিবিদরাও তিরুপতি মন্দিরে আসেন।
দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের চিত্তুর জেলায় তিরুমালার শিখরে তিরুপতি বালাজির মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হলেন বিজয়নগরের রাজা শ্রীকৃষ্ণ দেবরায়। তামিল ভাষায় তিরুমালা কথার অর্থ হল পবিত্র পাহাড়। সমতলে তিরুপতি স্টেশন লাগোয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে চড়ে পাড়ি দিতে হয় ৮৬০ মিটার উচ্চতার তিরুমালা মন্দির শহরে। চড়াই উৎরাই, ৫৭টি হেয়ার পিন বেন্ড পেরিয়ে ২৫ কিমি (৪৫ মিনিট) এই পাহাড়ি পথের শোভা আপনার ট্রেনযাত্রার ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে।
উৎসাহী বা যারা মানত করেন তাদের জন্য অ্যালিপিরি থেকে ছাউনিযুক্ত হাঁটা-পথ (১৫ কিমি) রয়েছে। পথে বিশ্রামঘর, ডাক্তার, পানীয় জল, ফ্রি খাবারের ব্যবস্থা এবং জঙ্গলের পথে (শ্রী ভেঙ্কটেশ অভয়ারণ্যের আওতাধীন) হরিণ, ময়ূর, শূকর, শেয়াল, বড় কাঠবিড়ালি, নানা পাখি দেখা যায়। প্রায় ৪ বর্গকিমি এলাকা নিয়ে মন্দিরকে কেন্দ্র করে তিরুমালা শহর। শীতকালের গড় তাপমাত্রা থাকে ১৫ ডিগ্রি। মন্দির সংলগ্ন স্বামী পুষ্করিণীর জলে স্নান করে পবিত্র হয়ে বালাজির দর্শন করার প্রথা রয়েছে। অগ্রিম টিকিট কেটে কম সময়ে দেব দর্শন করা যায় আবার ফ্রি দর্শনেরও ব্যবস্থা আছে।
মন্দিরে প্রবেশ করতে হলে প্রত্যেকের আইডি কার্ড থাকা দরকার এবং পোশাক ভারতীয় রীতির পরিধান করা আবশ্যক। পুরুষদের ধুতি-পাজামা-পাঞ্জাবি-জামা ও মহিলাদের শাড়ি- শালোয়ার কামিজ ও ওড়না পরা বাঞ্ছনীয়। মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বার বা গোপুরমটি ২৫০ ফুট উঁচু দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যের নিদর্শন।
মন্দিরের মধ্যে সোনার পাতে মোড়া ধ্বজস্তমভ বা তালগাছ। মন্দিরের মধ্যে অসাধারণ পাথরের কারুকার্য, দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। মূল মন্দিরটির চূড়া সোনা দিয়ে মোড়া। উৎসবের সময় ছাড়া, প্রতিদিন গড়ে কুড়ি হাজার ভক্তের সমাগম হয়। তাই কমপক্ষে ৩-৫ ঘণ্টা দীর্ঘ লাইন অতিক্রম করেই তিরুপতি বালাজির দর্শন পাওয়া যায়।
মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রদীপের স্বল্প আলোয় দেবদর্শন। মনিমুক্তা, স্বর্ণালঙ্কার ও পুষ্পমালায় সজ্জিত ২ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট কষ্ঠিপাথরের চতুর্ভুজ দেবতা বালাজি দণ্ডায়মান, দুইহাতে শঙ্খ ও চক্র, অন্য হাত অভয়মুদ্রা ও আর এক হাত কোমরে ন্যস্ত, পাশে শ্রীদেবী ও ভূদেবী।
বালাজি ছাড়াও মন্দিরের অন্য আকর্ষণ দান করা টাকা পয়সার গণনা ঘর, দেবতার পালকি, উৎসবে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র, রাজা মহারাজাদের তৈলচিত্র, পেল্লায় সাইজের দাঁড়িপাল্লা (বাচ্চার ওজনে খুচরো পয়সা দান করার রীতি) ইত্যাদি। মানত করলে, পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে মস্তক মুণ্ডনের প্রথা রয়েছে। এখানে ফুল ফলের ডালি দিয়ে পূজো দেওয়ার রীতি নেই, ভগবানের উদ্দেশে প্রণামী হিসাবে অর্থ হুন্ডিতে (পয়সার ভান্ডার) দান করাই নিয়ম।
ভক্তরা মন্দিরের বাইরে একটি স্থানে কর্পূরের দীপ জ্বালিয়ে, নারকেল ফাটিয়ে অর্ঘ্য দেয়। বালাজি দর্শনের পর প্রত্যেক দর্শনার্থীকে লাড্ডু অথবা পোলাও প্রসাদ দেওয়া হয়। অতিরিক্ত লাড্ডু প্রসাদ নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে এক জন ব্যক্তি ৫০ টাকার বিনিময়ে সর্বাধিক দুটি ক্রয় করতে পারেন। এ ছাড়া দর্শন টিকিটে মাথাপিছু দুটি করে লাড্ডু ফ্রি পাওয়া যায়।
মন্দিরের অদূরে বিশাল বড় চারটি ডাইনিং হলে (প্রতি হলে দু’হাজার লোক বসতে পারে) প্রতিদিন দুই বেলা নিঃশুল্ক অন্নপ্রসাদের ব্যবস্থা রয়েছে (ভাত, সাম্বার, রেশম, সবজি, চাটনি, নলেন গুড়ের পায়েশ ও ঘোল। অমৃতসম এই প্রসাদ প্রতিদিন ৫০,০০০ মানুষ গ্রহণ করে। উৎসবের সময়ে দেড় লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। ডাইনিং হলের পরিচ্ছন্নতা, একসাথে এতো লোককে খাওয়ানোর সুন্দর ব্যবস্থাপনা, কলাপাতায় খাদ্য পরিবেশন, ফিল্টার্ড পানীয় জল, হলের মধ্যে মাছি-মশার প্রবেশ আটকানোর জন্য মেসিন ইত্যাদি ব্যবস্থা আপনাকে মুগ্ধ করবে।
■■ স্বর্ণ ভান্ডার :::: একটি হিসেবে দেখা যায়, তিরুপতি তিরুমালা কর্তৃপক্ষ ৫ হাজার ৫শ কেজি স্বর্ণ ব্যাংকে জমা রেখেছে যার বাজার দর ১ হাজার ৩শ ২০ কোটি রুপি। শুধু মাত্র কিছুদিন আগে, একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ১৩১১ কেজি স্বর্ণ জমা করেছে।
বর্তমানে, স্বর্ণ ও নগদ সহ এই মন্দিরের সম্পদের পরিমাণ ভারতীয় রুপিতে ১ লক্ষ কোটি রুপি-র উপরে। মনে করা হচ্ছে, তিরুপতি মন্দির কর্তৃপক্ষ আগামী বছরের শুরুতেই, সাড়ে পাঁচ টনেরও বেশি পরিমাণ সোনা প্রকল্পের আওতায় জমা রাখবে।
■■ চুল বিক্রি করে আয় :::: তাঁর ভাণ্ডারে যে অর্থের কমতি নেই, সে কিছু নতুন কথা নয়। স্বয়ং ভগবানই কথা দিয়েছিলেন ভক্তদের, তাঁর মন্দিরে এসে যিনি অর্থ দান করবেন, তিনি চিরতরে মুক্ত হবেন পৃথিবীবাসের যাতনা থেকে।
ভগবান ভেঙ্কটেশ্বরকে এভাবে কুবেরের ঋণ শোধ করতে সাহায্য করলে ভক্তরা পাবেন বৈকুণ্ঠ বাসের অধিকার! সেই মতো ভক্তদের নানাবিধ দানে উপচে ওঠে তিরুপতি বালাজি মন্দিরের দানপাত্র। যা মন্দিরের আয় এবং ভগবানের ঋণশোধ- দুইয়ের সহায়ক হয়।
প্রতি দিন আগত অনেক ভক্তই চুল উৎসর্গ করে থাকেন ভগবানকে। পুরুষ-নারী নির্বিশেষেই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলে ভগবানকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য এই পন্থা অবলম্বন করেন। ফলে প্রতি দিন এভাবে জমতে জমতে মাসের শেষে বেশ বিপুল পরিমাণেই কর্তিত কেশরাশি জমা হয় তিরুপতি বালাজি মন্দিরে। সেই চুলই যখন নিলামে উঠল, দু’ মাস মিলিয়ে দাম মিলল ১৭.৮২ কোটি। গত জুলাই মাসে চুল বিক্রি করে তাদের লাভ হয়েছিল ১১.৮৮ কোটি টাকা।
■■ কী ভাবে যাবেন :::: হাওড়া ও সাঁতরাগাছি থেকে ৫টি ট্রেন সরাসরি তিরুপতি যাচ্ছে। এ ছাড়া দূরন্ত বা এসি স্পেশাল আরো ছ’টি ট্রেন রেনিগুন্টা হয়ে যাচ্ছে। কম বেশি ২৫ ঘণ্টার যাত্রাপথ। রেনিগুন্টা থেকে অটো/বাসে তিরুপতি বা সরাসরি তিরুমালা যাওয়া যায়। তিরুপতি স্টেশনের বাইরে তিরুমালার সরকারি বাসের টিকিট কাউন্টার।
রিটার্ন টিকিট কেটে বাসের বাম দিকে জানালার ধারে অথবা ড্রাইভারের কেবিনে সিট দখল করুন। রিটার্ন টিকিট ৩ দিন বৈধ এবং মাথাপিছু ১০ টাকা ছাড় পাওয়া যায় (রাত ১২টা-সকাল ৩টা বাস সার্ভিস বন্ধ থাকে)।
২ কিমি এগিয়ে চেকিং পয়েন্ট। গাড়ি ভাড়া করেও যেতে পারেন। যাত্রী, লাগেজ, গাড়ি তল্লাশির পর পাহাড়ে ওঠার অনুমতি মেলে। তিরুমালা পাহাড় সম্পূর্ণ নিরামিষ এবং তামাক/অ্যালকোহল জাতীয় দ্রব্য নিষিদ্ধ। এধরনের কোনও বস্তু সঙ্গে রাখবেন না।
■■ কোথায় থাকবেন :::: “তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানমস্”(TTD)-এর প্রচুর গেস্ট হাউস রয়েছে। ননএসি ১০০/৫০০ এসি ১০০০/১৫০০। অনলাইন রুম বুকিং করা যায়।
Website: www.ttdsevaonline.com
মনে রাখবেন, বুকিং করলে তা বাতিল হয় না (বুকিং অর্থ বালাজি ফান্ডে দান হয়ে যায়)। ঘর একদিনের জন্য বুকিং হয়। বিশেষ অনুরোধে স্পট রিজার্ভেশন অফিস থেকে অতিরিক্ত এক দিন বর্ধিত করা যায়। পাহাড়ে নানা সংস্থার গেস্ট হাউস ও ধর্মশালা আছে। স্টেশনের আশেপাশে TTD-র গেস্ট হাউস ও লাক্সারী হোটেল আছে।
■■ কি দেখবেন :::: মূল মন্দিরের আশেপাশে নানা দেব দেবীর মন্দির আছে….বরাহ স্বামী মন্দির, অঞ্জণা স্বামী মন্দির, রাম মন্দির, এছাড়া বিবাহ মন্ডপ, বৈদিক মন্ডপ, গোশালা, কল্যানকাটা ইত্যাদি। তিরুমালা থেকে সকালে জিপ/সুমো/মারুতি/মিনিবাস ভাড়া করে (মাথাপিছু ১০০ টাকা) ৫-৭ ঘন্টায় আটটি সাইট সিন ঘুরে আসা যায়।
1. বেণুগোপাল স্বামী মন্দির, 2. পাপবিনাশম তীর্থ, 3. আকাশগঙ্গা ঝর্না, 4. জপালী হনুমান মন্দির (গাড়ি থেকে নেমে ২ কিমি হাঁটাপথ), 5. ঝুলন্ত পাথর, 6. চক্রতীর্থম্, 7. শ্রী হরি পাদালু (পদচিহ্ন) ও 8. SV মিউজিয়াম।
তিরুপতিতেও (সমতলে) সাতটি দর্শনীয় মন্দির আছে। বাসস্ট্যান্ড বা গেস্ট হাউসের সামনে থেকে প্রচুর গাড়ি পাবেন। সকালে বেরিয়ে প্রথমে চলুন কপিলাতীর্থম। এখানে শিব পার্বতীর মন্দির ও ঝর্না, বর্ষা ও শীতে ঝর্নায় জল থাকে…স্নান করা যায়।
এর পরে চলুন পদ্মাবতী মন্দির (বালাজির পত্নী)। এখানেও টিকিট কেটে বা ফ্রি দর্শন করতে হয়। তবে এখানে ভিড় বেশি হয় না। এখানেও ফ্রি অন্ন প্রসাদ পাওয়া যায় (জায়গা সীমিত)। এর পর শ্রীনিবাসা মঙ্গাপুরম, অগস্তস্বরা স্বামী মন্দির, কোদন্ডারামাস্বামী মন্দির, গোবিন্দরাজস্বামী মন্দির (দুপুরে বন্ধ থাকে) ও ইসকন মন্দির ঘুরে নেওয়া যাবে। এখান থেকে চন্দ্রগিরি দূর্গ (১১ কিমি), পুষ্পগিরি পাহাড় (১২ কিমি), শ্রীকালহস্তী (৩৭ কিমি), ভেলোর ফোর্ট (১২০ কিমি) ও আরও ৮ কিমি দূরে গোল্ডেন টেম্পল যেতে পারেন।
■■ ঘরে বসেই দর্শন :::: যারা ভ্রমণ করতে অসমর্থ সেই সব ভক্তরা এবার ঘরে বসেই তিরুপতি মন্দির দর্শন করতে পারবেন। এই প্রথমবার তিরুমালা তিরুপতি দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে ক্যামেরার জন্য। মন্দির থেকে বিগ্রহ – গোটা সফর সামনে থেকে চাক্ষুস করাবে ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফির নতুন ডকুমেন্টারি ‘ইনসাইড তিরুমালা তিরুপতি।’
■■ পুজো :::: সকাল ,সন্ধ্যা ,রাত্রি যে কোনো সময় মন শান্ত করে মনোকামনা পূর্ণকারী শ্রীভেঙ্কটেশ্বর গোবিন্দ বালাজীর মহামন্ত্র ১০৮বার পাঠ করতে হবে। সারাদিনে এই মন্ত্র যতবার মনে মনে পাঠ করা যায় ,ততই শুভ মঙ্গল ফল প্রদান করে।
“ॐ নমো শ্রীভেঙ্কটেশায় কামিতফলদায়িনে, প্রণত ক্লেশনাশায় গোবিন্দায় নমঃ।”
শ্রীভেঙ্কটেশ্বরস্বামী,যিনি কলিতে কামকল্পতরু গোবিন্দ রূপে ভক্তের কামনার ফল প্রদান করেন,যিনি শ্রীচরণে প্রণত,আশ্রিত ভক্তের সকল ক্লেশ নাশ করেন, সেই গোবিন্দ কে আমি বার বার প্রনাম করি।
শ্রীচরণে তুলসী অর্পণে শ্রীগোবিন্দ অত্যন্ত প্রসন্ন হন। ১০৮,২১, ১১ বা ২টি তুলসীপাতা অর্পণ করে বলতে হবে — ॐ শ্রীভেঙ্কটেশায় গোবিন্দায় নমো। প্রতিদিন এই পূজা করা যেতে পারে। মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার,শুক্রবার ও একাদশী ও পূর্নিমা তিথি বিশেষ ফলপ্রদ। ২১ দিন ভক্তি ভরে এই সহজ পূজা নিত্য করলে শ্রীগোবিন্দ কৃপায় শুভ, মনোকামনা পূর্ণ হয়।
♥গোবিন্দা ! গোবিন্দা ! গোবিন্দা♥
জয় শ্রীভেঙ্কটেশ,জয় গোবিন্দ,জয় বালাজী জয়