বাঁকুড়ার কয়েকটি বিখ্যাত শিবগাজন

বেদে দেবতা হিসাবে শিব বা মহাদেবের কোনও উল্লেখ নেই। সেখানে ‘রুদ্র’ বলে এক দেবতার উল্লেখ আছে, যার চরিত্র আমাদের পুরাণের শিব বা মহাদেবের সঙ্গে মিলে যায়। রুদ্র বন্য জন্তুর মতো ধ্বংসকারী; আবার পাপ হতে সকলকে নিষ্কৃতি দেন। ঋকবেদে আছে রুদ্র একাধারে রুদ্র (ভয়ানক) ও শিব (মঙ্গলময়)। এই ‘শিব’ বিশেষণ বৈদিক রুদ্রকে পৌরাণিক শিবে পরিণত করেছে। শিব সংহার কর্তা। আবার তিনি অতি সহজেই তপস্যায় তুষ্ট হন। তাই তিনি আশুতোষ। উপনিষদে রুদ্র বলেছেন, “আমি সর্বপ্রথমে আগত, আমার পূর্বে ও উপরে কেউ নেই”। আমি চিরন্তন আবার আমি চিরন্তন নই। আমার আদি, মধ্যম ও অন্ত কিছু নেই। এজন্য হয়তো পুরাণের দেবাদিদেব – মহাদেব।
শিব তার অনুচর দ্বারা বেষ্টিত হয়ে হিমালয়ে তপস্যা করেন। তার অনুচররা হলেন চারন, অপ্সরা, যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধর্ব, কিন্নর, সিদ্ধ, প্রমথ ও ভূত। এদের মধ্যে অনেকে হলেন দেবযোনি। দেবতা থেকে যাদের জন্ম তাদের দেবযোনি বলা হয়। দেবতা ও মানুষের মধ্যবর্তী প্রাণী হল দেবযোনি। পুরাণে ১০ প্রকার দেবযোনি আছে, যথা বিদ্যাধর, অপ্সরা, যক্ষ, রক্ষ বা রাক্ষস, গন্ধর্ব, কিন্নর, পিশাচ, গুহ্যক, সিদ্ধ ও ভূত। পুরাণেই আছে শিব সর্বপ্রকার ভুতের অধিকারী। তিনি শ্মশানে সর্প জড়িত মস্তকে, গলদেশে কঙ্কাল ভূষিত হয় অনুচরদের সঙ্গে ভ্রমণ করেন। তাই বাংলার লোক পার্বণ শিব গাজনে শ্মশান, ভূত ইত্যাদির যোগ পাওয়া যায়। যেমন শ্মশান থেকে মড়াকাঠ আনা অর্থাৎ শবদাহের পর পরিতক্ত অর্ধদগ্ধ কাঠ এনে আগুন ধরানো, শ্মশান থেকে ভূত আনা (শ্মশান থেকে শবদেড়র হাড় আনা, কোথাও কোথাও মড়ার মাথার খুলি এনে নৃত্য করা হয়। মন্দিরে আগামী এক বছরের জন্য ভূত রেখে দেওয়া ইত্যাদি। বাঁকুড়া জেলার কয়েকটি শিব গাজনে এরকম প্রথা আছে। চৈত্র সংক্রান্তির দোরগোড়ায় এসে কয়েকটি বিখ্যাত গাজনের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো।
  • ১) জগন্নাথপুর গ্রামের বাবা রত্নেশ্বর জীউয়ের গাজন, (গদারডিহি অঞ্চল), থানা – বেলিয়াতোড়:
বাঁকুড়া জেলার একটি বিখ্যাত শিবগাজন হল বেলিয়াতোড় থানা এলাকার জগন্নাথপুর গ্রামের বাবা রত্নেশ্বর জীউয়ের গাজন। রত্নেশ্বর শিবমন্দিরটি খুব বিখ্যাত। মাকড়া পাথরের দেউল মন্দির, মাথায় আমলক শিলা। মন্দিরের উচ্চতা ৩০ ফুট। মন্দিরের ভেতরে কুণ্ডের মধ্যে শিবলিঙ্গটি প্রাচীন এবং অনাদি লিঙ্গ বলে খ্যাত। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা পাত্রসায়র থানার অন্তর্গত হোদলনারায়ণপুরের রাজারা। এই রাজাদের তৈরি মন্দির খ্রিষ্টীয় সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। গাজনের বয়স আনুমানিক দুশো বছর। এরকমই দাবী করেন মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। গাজনটি হয় চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে।
গাজনের ঢাকে কাঠি পরে পয়লা চৈত্র থেকে। বাস্তবিকই পয়লা চৈত্র থেকে একবার ঢাক বাজে আর ১৫ই চৈত্র থেকে দুবার ঢাক বাজে। ২১শে চৈত্র থেকে মন্দিরে প্রতি সন্ধ্যায় রামায়ণ গান শুরু হয়। মূল গাজনের সূত্রপাত হয় ২৮শে চৈত্র। এদিন হয় ‘মদ ভাঙ্গা’। মদ ভাঙার অর্থ হলো এক সময় নতুন মৌচাকের মধু বের করে সেই মধু দিয়ে রত্নেশ্বর এর পাট টি চান করানো হতো। তাকে বলা হতো মধু ভঙ্গ। বর্তমানে মধু ভঙ্গ থেকে মদ ভাঙ্গায় পরিবর্তন হয়েছে। এদিন ভক্তারা স্থানীয় মহিষাপুকুরে স্নান করে উদরি অর্থাৎ উপবীত ধারণ করে এবং বাবা রত্নেশ্বরকে পুষ্পাঞ্জলি দেয়। এদিন নিজ গোত্র থেকে শিব গোত্রে আসে ভক্তারা। তারপর বাবার পাট অর্থাৎ লৌহশলাকা বিদ্ধ পাটাতন বার করা হয়।
গ্রামসংলগ্ন ‘বীরবাঁধ’ পুকুরে ‘পাট চান’ করিয়ে গ্রামে ঘুরে মন্দিরে ফেরে। সঙ্গে থাকে ঢাক, ঢোল, কাঁসি, ইত্যাদি সব বাদ্যযন্ত্র। পরদিন দিনগাজন। এদিন আশেপাশের গ্রাম থেকে পাট আসে। যেমন হাট আশুরিয়া (বড়জোড়া থানা), গোঁসাইপুর (বেলিয়াতোড় থানা), বেলুট (বেলিয়াতোড় থানা), মাঝিডাঙা (সোনামুখী থানা), রামপুর (সোনামুখী থানা)। পাটগুলি বিভিন্ন সময়ে নিয়ে আসে ঐখানের ভক্তারা। মন্দির প্রদক্ষিণ করে পাটটি মন্দিরের ‘গম্ভীরে’ অর্থাৎ গর্ভগৃহে প্রবেশ করানো হয়। তারপর পূজা অর্চনা করা হয়। গাজনের তৃতীয় দিন হল রাতগাজন। এদিন চৈত্র সংক্রান্তি। এদিন হল গাজনের মূল আকর্ষণ। এদিন রাতে বাবার পাট শোভাযাত্রা সহকারে নিয়ে যাওয়া হয় বীরবাঁধ পুকুরে স্নানের উদ্দেশ্যে।
মন্দির থেকে পুকুরের দূরত্ব ৫০০ মিটার। ফেরার সময় শোভাযাত্রায় থাকে ধামাৎকন্যা। অর্থাৎ পাটের ওপর পাট ভক্তা শুয়ে থাকে, তার ওপর মন্দিরের পুরোহিত এক পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। থাকে ‘গাড়িবাণ’। গরুর গাড়ির ওপরে আড়াআড়ি বাঁশ বেঁধে তাতে পা বেঁধে মাথার নীচে অগ্নিকুণ্ড রেখে ভক্তাকে দোলানো হয়। অর্থাৎ গরুর গাড়িতে হিন্দোল সেবা। আর থাকে অগ্নি বাণ। ভক্তারা হাতে, জিভে যে বাণ ফোঁড়ে তার আগায় কাপড়ে পেঁচিয়ে, সর্ষের তেলে ভিজিয়ে আগুন দেয়। বাণ ফোঁড় সহ শোভাযাত্রা মন্দিরে ফিরতে ভোর হয়ে যায়। পরদিন সকালে সকলের জন্য থাকে ‘লক্ষ্মণ ভোজ’। নিরামিষ অন্ন সকলের জন্য প্রসাদ হিসাবে থাকে। এদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের দিন মন্দির প্রাঙ্গনে ভক্তারা বাড়ির লোকেদের নিয়ে মাছভাত খায়। একটা বেশ চড়ুইভাতির পরিবেশ তৈরি হয়। এই উপলক্ষ্যে মেলা শুরু হয়ে যায় মোদভাঙ্গার দুদিন আগে থেকে। চলে পয়লা বৈশাখের পরের দুদিন পর্যন্ত। শেষদিন থাকে কলকাতার নামী দলের যাত্রাপালা।
জগন্নাথপুর রত্নেশ্বর মন্দিরের সামনে ভক্তরা ৷
  • ২) দধিমুখা গ্রামের বাবা গঙ্গাধর জীউয়ের গাজন (গদারডিহি গ্রাম পঞ্চায়েত), থানা – বেলিয়াতোড়:
দধিমুখা গ্রামটি বড়জোড়া ব্লকের এবং বেলিয়াতোড় থানার অধীনে খুব বনেদী গ্রাম। শুধু বনেদী নয়, ঐতিহ্যবাহীও বটে। এখানের গাজনটি প্রায় ১৫০ বছরের প্রাচীন। এই গ্রামে চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে হয় শিবগাজন। এখানে শিবগাজন হয় বাবা গঙ্গাধর জীউয়ের নামে। কথিত আছে পূর্বে এই স্থানে জঙ্গল ছিল। পার্শ্ববর্তী গ্রাম হরেকৃষ্ণপুরের এক গোয়ালার গরু এখানে চরতে আসত আর ফিরে গিয়ে দুধ দিতনা। দুধ না পেয়ে ঐ গোয়ালা গরুর পিছু নিয়ে এসে দেখতে পান গরু নিজে নিজে দুধ ছেড়ে দিচ্ছে এক স্থানে। সেখানে মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় গঙ্গাধরকে। তারপর সেই গোয়ালা স্বপ্ন পান এবং ঐখানে প্রতিষ্ঠা করেন গঙ্গাধরকে। পরে ঐ গোয়ালারা দধিমুখাকে দান করে দেন এই মন্দির।
এখনও গাজনের সময় হরেকৃষ্ণপুরের গোয়ালাদের পরিবার থেকে একজনকে ভক্তা হতে হয়। গাজনটি হয় চারটি পর্বে। মধুভাঙ্গা, দিনগাজন, রাতগাজন ও চড়ক। মধুভাঙ্গার দিন সকালে ভক্তারা কামায়। অর্থাৎ চুল, দাড়ি, নখ কেটে উদরি বা উপবীত নেয়। ভক্তার সংখ্যা হয় ৭০/৮০ জন। তারপর বিকালে বের হয় মধু ভাঙতে। গ্রামে ঘুরে ঘুরে মৌচাক ভেঙ্গে মধু সংগ্রহ করে। সেই মধু বাবার মাথায় ঢেলে পুজো করে। তারপর মন্দির থেকে পাট অর্থাৎ লৌহশলাকা বিদ্ধ পাটাতন নিয়ে এক কিলোমিটার দূরবর্তী বেনেপুকুরে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। স্নান সেরে মন্দিরে আনা হয়। তারপর মন্দিরে হয় ঘট পূজা। বিকালের মধ্যে কুমার পাড়া থেকে ঘট চলে আসে। ঘট পূজার পর হয় আগুন সন্ন্যাস। আসলে এটা হয় হিন্দোল সেবা। হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ করে ভক্তাদের ঝুলিয়ে দেওয়া হয় অগ্নিকুণ্ডের ওপর। অগ্নিকুণ্ডতে ধুনো ছড়ানো হয়। এই অবস্থায় দোল খায় ভক্তারা। প্রায় সব ভক্তারা এতে অংশগ্রহণ করে। এদিন বাড়িতে ভক্তারা হবিষ্যি খায়। হবিষ্যিতে থাকে আতপ চাল, ঘি ও মধু। আতপ চাল সিদ্ধ করতে হয় আখের ছিবড়া জ্বাল দিয়ে। এই হবিষ্যি চিবিয়ে খাওয়া যাবে না, গিলে খেতে হবে। খাওয়ার সময় কেউ কোন কথা বলবে না। কথা হলেই খাবার অসম্পূর্ণ রেখে উঠে যেতে হবে।
পরদিন দিনগাজন। এদিন পাট বের হয় বিকাল তিনটের সময়। গ্রাম পরিক্রমা করে পাট যায় হরেকৃষ্ণপুর গ্রামে বাবুদের বাড়ি অর্থাৎ সিংহ পরিবারে। সেখানে ভক্তারা সম্মান জানায়। পরিবর্তে ভক্তাদের জল খাওয়ায় সিংহ বাড়ি। তারপর বেনেপুকুরে স্নান সেরে মন্দিরে ফেরে। তারপর মন্দিরে এসে আগুন সন্ন্যাস তথা হিন্দোল সেবা হয়। তার পরদিন রাতগাজন। এদিন সকালে সাধারণ ভক্তকূল দণ্ড সেবা কাটে অর্থাৎ দণ্ডী কাটে। ভক্তারা দাগ দিয়ে দেয়। সন্ধ্যায় পাট বের হয়। সেই বেনেপুকুরে স্নানের জন্য যায়। এদিন একটা পর্ব থাকে পাট ভাঙ্গা। সমস্ত ভক্তাকে একবার করে পাটে উঠতে হয়। পাটটিকে পুকুরঘাটে রেখে ভক্তারা বাণ ফোঁড়া শুরু করে। প্রথমে গ্রামের লোহারদের থেকে দশমুখী বাণ ফোঁড়ে, তারপর বাউড়িদের থেকে, তারপর মুচি, তারপর ডোম। মত নটি দশমুখী বাণ ফোঁড়া হয়। দশমুখী বলতে পাঁচটি বাণ। সবশেষে ফোঁড়া হয় গম্ভীর বাণ। এটি একটি মোটা লোহার শিক। লোহার পরিবার থেকে একজন ভক্তা এই বাণ ফোঁড়ে। তারপর তাকে ধরে ধরে মন্দির পর্যন্ত আনা হয়। এর মাঝে প্রতি প্রহরে পুকুরপাড়ে রাখা পাটটিকে নিয়ে পাট ভক্তা সঙ্গে একজন ঢাকি নিয়ে গ্রাম পরিক্রমা করে আসে। মূল শোভাযাত্রায় বাদ্যযন্ত্র সহ নৃত্য চলতে থাকে। এসব করতে করতে ভোর হয়ে যায়। পরদিন চড়ক। এখানে চড়ক গাছ দুটি।
স্থানীয় একটি পুকুরে, যার নাম সাতপুকুর সেখানে এই শাল কাঠের দুটি চড়ক ডোবানো থাকে। চড়কের আগের দিন গিয়ে পান, সুপারি, বাতাসা, মণ্ডা দিয়ে চড়ককে নিমন্ত্রণ করে আসা হয়। পরদিন শুধু গিয়ে ডাকলেই শাল কাঠ দুটি ভেসে ওঠে। সেই শাল গুঁড়ি দুটোকে মাটিতে পোঁতা হয়। শাল কাঠের ওপর আর একটি কাঠের দণ্ড আড়াআড়ি ভাবে রাখা হয়। এটাকে বলে চড়ক গাছ। এবার ভক্তাদের পিঠের চামড়াতে বাঁকানো লোহার শিক বা দণ্ড ফোঁড়া হয়। শিকের সূঁচালো প্রান্তটি পিঠের চামড়ায় ফোঁড়া হয়। অপরপ্রান্তে দড়ি বাঁধা থাকে। এই দড়িটি চড়ক গাছের ওপরের আড়াআড়ি ভাবে রাখা দণ্ডের এক প্রান্তে বাঁধা হয়। এরপর ঐ ভক্তাকে ঐ প্রান্তে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। অপরপ্রান্তে কয়েকজন লোক দড়ি ধরে ঘোরাতে থাকে। প্রায় ৪০ জন ভক্তা চড়কে ঘোরে। দুটি চড়কের একটি বাউড়িদের জন্য অপর চড়কটি লোহার, মুচি ও ডোমদের জন্য নির্দিষ্ট। যে সব ভক্তা চড়কে ঘোরেন তারা শাড়ি পড়েন। এটা একটি অভিনব ব্যাপা এই চড়কের দিন দধিমুখাতে বড় মেলা বসে। পরদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের দিন রাতে ভক্তাদের জন্য থাকে লক্ষ্মণ ভোজ। গ্রাম ষোল আনার তরফ থেকে তাদের মাছভাত খাওয়ানো হয়।
দধিমুখার চড়ক ৷
  • ৩) পিড়রাবনী গ্রামের চন্দ্রশেখর জীউয়ের গাজন, (পিড়রাবনী গ্রাম পঞ্চায়েত), থানা – বেলিয়াতোড়:
পিড়রাবনী গ্রাম পঞ্চায়েতে এই একটি মাত্র শিবগাজন। তাই এতদ্‌ অঞ্চলের সমস্ত লোক এই গাজনে অংশগ্রহণ করে। এজন্য এতে ভক্তার সংখ্যা হয় প্রায় ৪০০/৫০০ জন। বাড়িতে আত্মীয় কুটুম্ব হিসাবে এসেও অনেকে ভক্তা হয়। এখানের গাজনের আনুমানিক বয়স ১০০ বছর। প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে গাজন হয়ে থাকে। ২১শে চৈত্র থেকে মন্দিরে রামায়ণ গান শুরু হয়, চলে সাত দিন। ২৫শে চৈত্র থেকে গাজনের আচার শুরু হয়ে যায়। এদিন পাট ভক্তা (প্রধান ভক্তা) র কামান হয়। তারপর পাট অর্থাৎ লৌহশলাকা বিদ্ধ কাঠের পাটাতনকে পুকুরে স্নান করাতে নিয়ে যায় পাট ভক্তা। পুকুরটি মন্দির থেকে ৪০০ মিটার দূরে, নাম উপরবাঁধ। পরদিনও একই কাজ। তার পরদিন অর্থাৎ ২৭শে চৈত্র সন্ধ্যাবেলা থেকে শুরু হয় ভক্তা কামান। যারা ভক্তে হবে তারা একে একে আসে মন্দিরে। ব্রাহ্মণ মন্ত্র পড়ে তাদের গলায় উদরি ঝুলিয়ে দেয়। তার আগে ভক্তেরা চুল, দাড়ি, নখ কেটে নেয়।
এই পদ্ধতি সারারাত কাবার করে পরদিন সকাল পর্যন্ত চলে। ২৮শে চৈত্র বিকালে পাট নিয়ে ভক্তারা বের হয়। গ্রাম পরিভ্রমণ করে উপরবাঁধ পুকুরে স্নান করিয়ে পাট মন্দিরে নিয়ে আসে। তার পরদিন রাতগাজন (২৯শে চৈত্র)। সন্ধ্যাবেলা পাট বের হয়। প্রথমে যায় উপরবাঁধ। সেখানে স্নান ও ঘাট পূজা হয়। বাণ ফোঁড়া শুরু হয়। বাণ ফোঁড়ে প্রায় ১০০ জন মতো। এখানে বাঁশ ফোঁড় হয়। বাঁশের সরু ছিলা বা কাঠি দিয়ে গায়ের চামড়া ফোঁড়ে। একটা গোটা বাঁশে ৮/১০ টা ছিলা বার করে চতুর্দিকে ৮/১০ জন ভক্তে বাণ ফোঁড়ে। আবার একটা লম্বা ধাতব তারে ৫/৬ জন ভক্তে একসঙ্গে সারিবদ্ধ ভাবে বাণ ফোঁড়ে। তারপর সবাইকে ধরে ধরে বাজনা সহকারে, বাকি ভক্তেদের নৃত্য সহকারে মন্দিরে নিয়ে আসে। পাটের ওপর পাট ভক্তা শুয়ে আসে। কিছু ভক্তে এবং সাধারণ ভক্তকুল দণ্ডী কেটে মন্দিরে আসে। সাধারণত যাদের মানসিক থাকে তারাই এটা করে। মন্দিরে ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে যায়। পরদিন সকালে হয় আগুন সন্ন্যাস। যজ্ঞের কাঠ অঙ্গার হয়ে গেলে তা মাটিতে বিছিয়ে দেওয়া হয়। তার ওপর দিয়ে ভক্তারা হেঁটে যায়। এদিন চৈত্র সংক্রান্তি। রাত আটটায় থেকে হয় চড়ক। চড়ক গাছ পুঁতে তাতে তিন জন ভক্তে ঘোরে। ইচ্ছাপ্রকাশ করলে আরও কেউ ঘুরতে পারে। এদিন এবং পরের দিন (পয়লা বৈশাখ) রাতে যাত্রা হয়। তেসরা বৈশাখ দিনে হয় লক্ষ্মণ ভোগ। খিচুড়ি, সব্জি ও চাটনি খাওয়ানো হয় ভক্তে তথা নিমন্ত্রিতদের ষোল আনার তরফ থেকে। এই উপলক্ষ্যে মেলা বসে ২৮শে চৈত্র থেকে ২রা বৈশাখ পর্যন্ত।
পিঁড়রাবনির চন্দ্রশেখর জীউ মন্দির ৷
  • ৪) ভুষতোড়া গ্রামের বাবা গঙ্গাধরের গাজন, (খাঁড়ারি গ্রাম পঞ্চায়েত), থানা – বড়জোড়া:
ভূষতোড়া গ্রাম একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। গ্রামের সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। গ্রাম থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন পুঁথি তার স্বীকৃতি বহন করছে। এজন্য এখানের শিবগাজনটি প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন। এখন এখানে একটি নব্য নির্মিত বাবা গঙ্গাধরের মন্দির আছে। চৈত্র সংক্রান্তির সময় গঙ্গাধরের গাজনটি হয়। এতে ভক্তার সংখ্যা হয় ১৫/২০ জন। প্রথমদিন হয় ভক্তা কামান। এদিন যারা ভক্তা হবে তারা চুল, নখ, দাড়ি কেটে শুদ্ধ হয়ে নেন। তার পরদিন উদরি গ্রহণ। এদিন ভক্তারা ব্রাহ্মণের কাছ থেকে উপবীত গ্রহণ করে। তার পরদিন হয় দিনগাজন। এদিন দুপুরে স্নানের জন্য পাট নিয়ে যাওয়া হয় ৭০০ মিটার দূরে হেদুয়া পুকুরে। স্নানের পর প্রথমে ভূষতোড়া গ্রাম ঘোরে। তারপর যায় প্রতিবেশী জামবেদিয়া গ্রামে। জামবেদিয়া গ্রামে একটি শিবমন্দির আছে। সেখানে পূজা করা হয়। তারপর আরেক প্রতিবেশী গ্রাম দেজুড়িতে যায়। তারপর দেউচা গ্রামে যায়। এখানে যে সব বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকে সেই সব বাড়িতে পাট নামে। সেখানে গৃহস্থ পূজা দেয়।
এই সব গ্রাম পরিক্রমা করে ফিরে আসে রাত বারোটার সময়। তার পরদিন রাতগাজন। এদিন সন্ধ্যায় গ্রামের চন্দ্রেশ্বর মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় পাট। সেখানে হোম হয়। তারপর যাওয়া হয় হেদুয়া পুকুরে। সেখানে ‘পাট চান’ হয়, ঘাট পূজা হয়। ভক্তারা দণ্ডী কেটে মন্দিরে ফেরে। যে সব মহিলারা মানত করে তারা ধুনো পোড়ায়। মেয়েরা মাথায় মাটির খোলা নিয়ে তাতে আগুন জ্বেলে তার মধ্যে ধুনো ছিটাতে ছিটাতে আসে। সব শেষে আসে ধামাৎকন্যা। অর্থাৎ পাট ভক্তা পাটের ওপর শুয়ে আসে আর মন্দিরের পুরোহিত তার ওপর দাঁড়িয়ে আসে। এখানে অবশ্য ধামাৎকন্যাকে ‘বাণেশ্বর’ বলে। পাটটিকেও বাণেশ্বর বলা হয়। এই সব শোভাযাত্রা সহ মন্দিরে ফিরতে হয়ে যায় রাত দুটো। তারপর মন্দিরে হয় হোম। তারপর ভক্তারা সেই হেদুয়া পুকুরে জল জাগাতে যায়। এখানে প্রথা হল বাণেশ্বর স্নান করে পুকুর থেকে উঠে আসলে সেই পুকুরে আর কেউ নামতে পারবে না। যতক্ষণ না ভক্তারা পুকুরের জল জাগাতে যাচ্ছে। এজন্য ভক্তারা পুকুরে গিয়ে হাতের বেতের লাঠি জলের ওপর সশব্দে আঘাত করে। ফেরার সময় একটি ঘটে জল তুলে নিয়ে আসে। একে বলে ‘কামলে তোলা’। তারপর যায় ভূত আনতে। ভক্তারা স্থানীয় শ্মশান থেকে মৃতদেহের অদগ্ধ বা অর্ধদগ্ধ হাড় কুড়িয়ে নিয়ে আসে মন্দিরে।
তারপর ভোরবেলা এই হাড় অন্যান্য কাঠের সঙ্গে মিশিয়ে আগুন ধরানো হয়। আগুন নিভে গেলে ভক্তারা উত্তপ্ত অঙ্গার হাতে করে নিয়ে মন্দিরের সামনে রেখে দেয়। এটাকে এখানে বলে আগুন সন্ন্যাস। তারপর ভক্তারা বাড়িতে ফিরে গিয়ে জল খায়। এর পরদিন চড়ক। এদিন চৈত্র সংক্রান্তি। আগে চড়ক ঘুরত, এখন বন্ধ। দুপুরে পুজোর পর যেখানে চড়ক ঘুরত সেই জায়গায় ভক্তা ও বাজনাদল সহ পুরোহিত যায়। একবার ঘুরে চলে আসে। রাতে হয় কবিগান বা অন্য কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আনন্দ ছাপিয়ে যেটার আনন্দ হয় সেটা হল ‘সব্জি কোটা’। পরদিন পয়লা বৈশাখ। এদিন দুপুরে হয় লক্ষ্মণ ভোজন। প্রায় তিন হাজার লোক খায়। ভূষতোড়া গ্রাম ছাড়াও প্রতিবেশী জামবেদিয়া, দেজুড়ি, দেউচা গ্রামের লোকজনের নিমন্ত্রণ থাকে। এরই জন্য সব্জি কাটা হয় সারারাত ধরে। পয়লা বৈশাখের দিন নিয়মভঙ্গ। ভক্তারা উদরি খুলে তেল হলুদ মেখে স্নান সেরে লক্ষ্মণ ভোজনের ভোজ খেয়ে বাড়ি যায়। ভোজনে থাকে ভাত, সব্জি, ডাল, পোস্ত, বোঁদে, মিষ্টি, চাটনি। এই সবগুলি খাদ্যদ্রব্যের খরচ কোন না কোন শুভানুধ্যায়ী বহন করেন। কিন্তু আপনি চাইলেই তৎক্ষণাৎ এই খরচের ভার বহন করতে পারবেন না। আপনি যদি মনে করেন বোঁদে খাওয়াবো, তাহলে আপনাকে হয়তো তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। এদিন রাতেও জলসা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। কোন মেলা বসে না। দুতিনটে খাবারের দোকান হয়ত বসে।
ভূষতোড়া গ্রামে লক্ষ্ন ভোজনের ব্যবস্থা ৷
  • ৫) বড়জোড়া গ্রামের বাবা ভুবনেশ্বরের গাজন (বড়জোড়া গ্রাম পঞ্চায়েত), থানা : বড়জোড়া
বড়জোড়া গ্রামে বাবা ভুবনেশ্বরের মন্দিরটি উনিশ শতকে তৈরী। ওড়িশা শৈলীর রেখে দেউল মন্দির। এই মন্দিরে চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে তে গাজন হয় তা প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন। এরকমই দাবী স্থানীয় বাসিন্দাদের। এখানে গাজন দুদিন, দিনগাজন ও রাতগাজন। তার আগে চলে আসে অসংখ্য ঢাক। প্রায় ১৫০ ঢাকি আসে। ঢাকের শব্দ মানেই গাজন শুরু। গাজন প্রক্রিয়া শুরু হয় গাজনের দুদিন আগে। এই দুদিন মন্দির থেকে বিকালে পাট বের হয়। প্রথমদিন নিয়ে যাওয়া হয় দশের বাঁধ পুকুরে। সেখানে স্নান করিয়ে মন্দিরে সন্ধ্যায় ফেরত আসে। তার পরদিন নিয়ে যাওয়া হয় মণ্ডল পুকুরে। এই দুদিনের মধ্যে ভক্তারা বার কামান করে নেয়। অর্থাৎ নখ, চুল, দাড়ি কেটে নেয়। এখানে ভক্তাকে বলে ‘ভক্তে’। এখানে ভক্তের সংখ্যা হয় প্রায় ১৫০। দিনগাজনের দিন সকাল দশটায় ভক্তেরা প্রায় দু কিলোমিটার খালি পায়ে হেঁটে ভৈরব ঠাকুরকে আনতে যায়। ভৈরব থানটি বাঁকুড়া বড়জোড়া রোডের কাছে একটি তেঁতুল গাছের তলায়। দুপুর একটার সময় ভক্তেরা নাচতে নাচতে ভুবনেশ্বর মন্দিরে ফেরে।
এই শোভাযাত্রায় কেউ শিব সাজে, কেউ লোকনাথ বাবা সাজে। ছৌ নাচের দল থাকে। যখন মন্দিরে এসে ভৈরব পৌঁছয় তখন ধুনা পোড়ানো হয়। যারা মানসিক করে তারাই ধুনা পোড়ায়। এদিন সন্ধ্যাবেলায়ও পাট স্নান করানো হয়। এদিন স্নান করানো হয় শিকল পুকুরে। রাতগাজন শুরু হয় পরদিন রাত দশটা থেকে। এদিন চৈত্র সংক্রান্তি। এদিন পাট কাঁধে নিয়ে ভক্তেরা দু কিলোমিটার দূরে মণ্ডল পুকুরে নিয়ে যায়। সেখানে ভক্তেরা স্নান করে। পাটের পূজা করে। তারপর কিছু ভক্তে দণ্ডী কেটে মন্দিরে আসে। কিছু ভক্ত অগ্নিবাণ নিয়ে আসে। অগ্নিবাণ হল পিঠে বাণ ফুঁড়ে অর্থাৎ ‘তার’ ফুঁড়ে। সেই তারের দুপ্রান্তে তেলে ভেজানো কাপড় জড়ানো থাকে। তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এই শোভাযাত্রায় গাড়িবাণ (দুটি গরুর গাড়ির মাঝে বাঁশ বেঁধে তাতে পা বেঁধে মাথা আগুনের ওপর দোলানো) থাকে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ধামাৎকন্যা। এটি সবার শেষে আসে। পাটের ওপর একজন ভক্তে শুয়ে থাকে। তার ওপর একজন ব্রাহ্মণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর পাটটিকে বাঁশে বেঁধে কাঁধে করে নিয়ে আসে। পাটের ওপর শুয়ে আসে প্রধান ভক্তা। এখানে প্রধান ভক্তাকে দিয়াশি বলে। ধামাৎকন্যা যে ব্রাহ্মণ হন, তারা বংশপরম্পরায় হয়ে আসছেন। ধামাৎকন্যা মন্দিরে ফিরলে তারপর দিয়াশি শ্মশানে যায়। সেখান থেকে এক টুকরো হাড় সংগ্রহ করে আনে।
মন্দিরে এসে কিছু কাঠে আগুন দেওয়া হয়। হাড়টিকে সেই আগুনে পোড়ানো হয়। তারপর সেই দগ্ধ হাড়টিকে মন্দিরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে রাখা হয়। তারপর মন্দিরের দরজা জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেবলমাত্র ভেতরে একজন পুরোহিত থাকেন। বলা হয় পুরোহিত ভূত জাগাচ্ছেন। এই ভূত সারাবছর মন্দিরে থাকবেন এবং গোটা বছর মন্দির তথা গ্রামকে রক্ষা করবেন। মন্দিরে সামনে যে আগুন দেওয়া হয়েছিল, তা পা দিয়ে ভক্তেরা সেই আগুন নেভায়। সবশেষে হয় আতিসবাজি প্রদর্শনী। এভাবে সকাল হয় অর্থাৎ নববর্ষের সূর্য ওঠে। এদিন থাকে বাউল গান এবং পরের দুদিন থাকে যাত্রা। পয়লা বৈশাখের দিন ভক্তাদের বিভিন্ন বাড়িতে নেমন্তন্ন করে নিরামিষ ভাত খাওয়ায়। এটাকে বলে ভক্ত ভোজন। তারপর দিন অর্থাৎ দুসরা বৈশাখ গ্রাম ষোলআনা পক্ষ থেকে ভোক্তাদের আমি ভাত খাওয়ানো হয় অর্থাৎ আঁশ পান্না করা হয়। এই উপলক্ষ্যে মেলা হয় একরাতের। মেলায় নানা দোকানপত্র বসে। মেলার জন্য প্রচুর লোকের সমাগম হয়।
বড়জোড়ার গাজনে ভৈরব আনা ৷
  • ৬) হাট আশুরিয়া গ্রামের বিরিঞ্চি নারায়ণের গাজন, (হাট আশুরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত), থানা : বড়জোড়া
হাট আশুরিয়া গ্রামের বিরিঞ্চি নারায়ণের গাজন খুবই ঐতিহ্যবাহী এবং প্রাচীন। এই গাজনের বয়স প্রায় ৪০০ বছর এরকমই দাবী স্থানীয়দের। এখানে বিরিঞ্চি নারায়ণ শিবলিঙ্গ। বলা হয় বর্গী হানায় বিগ্রহ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। শিবলিঙ্গের গায়ে সত্যি সত্যি ভগ্ন চিহ্ন আছে। তারপর নীলকর সাহেবরা একটি ছোট মন্দির তৈরি করে দেয়। প্রথমে গাজনের ভার ছিল রায় দের। এখন অবশ্য দায় বিশ্বাস দের। চৈত্রমাসের শেষ পাঁচদিন ধরে চলে এখানে গাজন। প্রথমদিন মন্দির থেকে পাট বার হয়ে কামারবাড়ি যায়, জলুই অর্থাৎ পাটে লাগানো পেরেকগুলি ঠিক করতে। তারপর সন্ধ্যায় পাট স্নান করিয়ে মন্দিরে ফেরে। দ্বিতীয় দিন ভৈরব আনা হয়। এদিন সকালে ভক্তারা বার কামান করে অর্থাৎ চুল, দাড়ি, নখ কেটে স্নান করে মন্দির থেকে দেড় কিমি দূরে মাঝের পাড়ায় ভৈরব থানে যায়। সেখান থেকে ভৈরব আনা হয় শোভাযাত্রা করে। ভৈরব আনা বলতে থানে থাকা মাটির হাতী ঘোড়ার ছলন গুলি আনা হয়। দুটোর সময় আনতে যাওয়া হয়। মন্দিরে ভৈরব আনার পর পাট বের হয় গ্রাম পরিভ্রমণে। গ্রামের বিভিন্ন মন্দিরে এমনকি মসজিদেও পাট যায়। তারপর আবার স্নান সেরে মন্দিরে ফেরে। তার আগে পাটের ওপর সমস্ত ভক্তা একবার করে শোয়, এটাকে বলা হয় অর্ঘ্যি দেওয়া। মন্দিরে ফিরে সবাই মন্দিরের সামনের আটচালায় বসে। পাট থাকে ভক্তাদের পিছনে।
তারপর ভক্তাদের কাঁধের ওপর দিয়ে পাট টেনে এনে মন্দিরে প্রবেশ করানো হয়। তার পরদিন দিনগাজন। এদিন সব ভক্তারা পাট নিয়ে যায় জগন্নাথপুরের রত্নেশ্বর শিবমন্দিরে। মন্দির থেকে ফেরার পথে গ্রামের ঘোষবাড়ি, সিংহবাড়ি এবং সোমণ্ডল পরিবারে যায়। সেখানে ভক্তাদের জল, মিষ্টি, ফল খাওয়ানো হয়। তারপর পুকুরে স্নান করে মন্দিরে পাট ঢোকে। এই পাট স্নান করানোর পুকুরের নাম পরিখা পুকুর বা বড় পুকুর। তার পরদিন নীলপূজা। এদিন রাতগাজন। রাতগাজনের দিন শ্মশান থেকে ভূত আনা হয়। এই ভূত আনাটা বেশ আকর্ষণীয়। এটা দেখার জন্য প্রচুর লোক জমায়েত হয়। একজন ভক্তে মন্দির থেকে ২ কিমি দূরের শ্মশান থেকে একটি হাড়ের টুকরো নিয়ে আসে। আনার সময় তাকে অন্যান্য ভক্তারা ‘এই ভূত’ ‘এই ভূত’ বলে ক্ষ্যাপায়। আর সেই ভূতরূপী ভক্তে তাদের দিকে ধেয়ে ধেয়ে যায়। এভাবে মন্দিরে ফেরে। নতুন আনা হাড়টি মন্দিরের সামনে অশ্বত্থ গাছের তলায় রাখা হয়। হাড়টি সে কোনমতেই হাতছাড়া করতে চায়না। রীতিমতো জোর করে তার কাছ থেকে হাড়টি কেড়ে নেয়া হয়। তারপর পাট নিয়ে যাওয়া হয় পরিখা পুকুরে।
পাট চান করিয়ে ভক্তরা কেউ দণ্ডী কেটে, কেউ লটন কেটে (গড়াতে গড়াতে), কেউ বাণ ফুঁড়ে, অগ্নিবাণ, শিবদোল্লা (নীচে আগুন জ্বেলে উপরে পা বেঁধে মাথা নীচে করে দোলা), হিন্দোল গাড়ি (দুটি গরুর গাড়ির মাঝে বাঁশ বেঁধে তাতে পা বেঁধে মাথা আগুনের ওপর দোলানো) করে ফেরে। আর থাকে ধামাৎকন্যা। পাটের ওপর একজন ভক্তা শুয়ে থাকে। একজন ব্রাহ্মণ তার ওপর দাঁড়িয়ে আসে। মন্দিরের সামনে আসার পর হয় আগুন খেলা। কাঠে আগুন জ্বেলে লোফালুফি খেলে ভক্তারা। আগুনে গড়াগড়ি খায়। যে ভক্তা ভূত এনেছিল, সেই ভক্তা আগুন নিয়ে এবং তার আনা ভূত নিয়ে মন্দিরে ঢোকে। তখন মন্দির থেকে আগের বছরের ভূত টিকটিকি, কাঁকড়া বিছে, ইত্যাদি হয়ে বেরিয়ে যায়। নতুন ভূতটিকে রাখা হয় কুলুঙ্গিতে হলুদ কাপড়ে মুড়ে। পরদিন চড়ক, চৈত্র সংক্রান্তির দিন। চড়কগাছ পোঁতা হয়। সমস্ত ভক্তরা চড়কে গামছা বেঁধে ঘোরে। তার পরদিন শিবযজ্ঞি। সমস্ত ভক্তাদের নিরামিষ ভাত খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকে। এই উপলক্ষ্যে পাঁচদিনের মেলা বসে। দুদিন যাত্রা হয়। ভৈরব আনার দিন এবং দিনগাজনের দিন। এছাড়া কীর্তন, বাউল গান ইত্যাদি হয়।
গড় আসুরিয়া গ্রামের বিরিঞ্চি নারায়ন মন্দির ৷