বরোবুদুর হল বিশ্বের বৃহত্তম বৌদ্ধ মন্দির, তথা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ স্মারক। ইন্দোনেশিয়া রাষ্ট্রের মধ্য জাভার মাগেলাঙে এই মহাযান বৌদ্ধ মন্দিরটি অবস্থিত। এটি তৈরি হয়েছিল নবম শতকে, শৈলেন্দ্র রাজবংশের শাসনকালে। মন্দিরটি জাভা বৌদ্ধ স্থাপত্যশৈলী অনুসারে নির্মিত। বরোবুদুরের স্মারকস্থলে গৌতম বুদ্ধের একটি পূজাবেদী ও একটি বৌদ্ধ তীর্থস্থান রয়েছে। ১৮১৪ সালে জাভার তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক স্যার টমাস স্ট্যামফোর্ড র্যাফলসের আমলে সারা বিশ্বে এই মন্দিরের অস্তিত্বের কথা ছড়িয়ে পড়ে। তারপর থেকে বেশ কয়েকবার সংস্কারের মাধ্যমে বরোবুদুর সংরক্ষিত হয়েছে। বৃহত্তম সংস্কার প্রকল্পটি চালানো হয় ১৯৭৫ ও ১৯৮২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। এই সংস্কার প্রকল্পটি পরিচালনা করেছিল ইন্দোনেশিয়া সরকার ও ইউনেস্কো। এরপর বরোবুদুর মন্দির চত্বর ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকাভুক্ত হয়।
ইন্দোনেশিয়ার আর এক নাম ছিল ইনসুলিন্দা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছোট-বড় প্রায় তিন সহস্র দ্বীপ অর্থাৎ অন্যতম বৃহৎ দ্বীপ-পুঞ্জ নিয়ে এই দ্বীপরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেকের মতে ইন্দোনেশিয়াকে সাগরকন্যা নামে অভিহিত করা হয়। জাভা,সুমাত্রা,বালিও বোর্ণিও প্রভৃতি দ্বীপ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া গঠিত। প্রাচীনকালে ভারতের সাথে এ দ্বীপগুলোর বাণিজ্যিক,রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় যোগাযোগ ছিল খুবই নিবিড়। ফলে ভারতীয় সংস্কৃতির অধিক প্রভাব পড়ে। তাই এ দ্বীপগুলোকে দ্বীপময় ভারত বলা হয়।ইন্দোনেশিয়া বর্তমানে বৃহত্তর মুসলিম রাষ্ট্র।ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে খ্রিষ্টপূর্ব ২য় শতকে ভারতীয়রা এখানে বসতি স্থাপন করে। বৌদ্ধ প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘মিলিন্দ প্রশ্নে’বাণিজ্যের জন্য সুবর্ণ ভূমি যাওয়ার কথা আছে।
কাশ্মীরের রাজা মিলিন্দ বা মিনান্দার ছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ২য় শতকের লোক। তিনি বুদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কারো মতে সুবর্ণ ভূমি বার্মা হলেও রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে সুমাত্রা,জাভা (যাভা) বোর্ণিও প্রভৃতি দেশই সুবর্ণভূমি (সুবর্ণদ্বীপ)। প্রথমে এখানে মূল সর্বাস্তিবাদ ও সস্মিতীয় মতবাদ প্রচারিত হয়েছিল,পরে মহাযানী মতবাদ প্রাধান্য পায়।খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শন এবং ভিন্ন মতবাদ ইন্দোনেশিয়ায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীতে ইন্দোনেশিয়া বুদ্ধের ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়।
সপ্তম শতাব্দীতে নালন্দার প্রখ্যাত শিক্ষাগুরু ধর্মপাল দক্ষিণ ভারতের ভিক্ষু বম্রবোধি তাঁর শিষ্য সমোক ইন্দোনেশিয়ায় পরিভ্রমণ করেন। অষ্টম শতাব্দীর শেষ দিকে ইন্দোনেশিয়ায় মহাযান বৌদ্ধমতের একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত হয় এবং তা হয় শৈলেন্দ্র রাজাদের (যাঁরা এই দ্বীপের অধিকাংশ শাসন করেছিলেন) পৃষ্ঠপোষকতা। তাঁদের রাজত্বকালে তারাদেবীকে উৎসর্গ কৃত কালসন (৭৭৯ খ্রি.) নির্মিত হয়। শৈলেন্দ্ররা কেন্দ্রীয় জাভার বরবুদুর বিশাল স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। তারা নাগাপটন এবং নালন্দায়ও বিহার নির্মাণ করান। ইন্দোনেশিয়ার যে সব এলাকায় বুদ্ধের ধর্ম প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল।
বম্রবোধি,তাঁর শিষ্য সমোক সপ্তম শতাব্দীতে ইন্দোনেশিয়া গমন করেছিলেন। পুনরায় অষ্টম শতাব্দীর শেষার্ধ্বে রাজা শৈলেন্দ্রবংশীয়দের পৃষ্ঠপোষকতায় ইন্দোনেশিয়া বা সাধারণত সুবর্ণদ্বীপ বলে খ্যাত ছিল। তথায় বাঙালি জাতি তথা বৌদ্ধদের প্রখ্যাত দার্শনিক অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান প্রথম জীবনে এগার শতাব্দীতে সুবর্ণদ্বীপের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিতাচার্য চন্দ্রকীর্তির নিকট ১২ বছর বুদ্ধধর্ম শিক্ষা করার জন্য গমন করেছিলেন (HCFE.p.27)| জাভার পূর্বদিকে বালিদ্বীপেও বুদ্ধধর্মের প্রসার ঘটেছিল। অতঃপর শৈলেন্দ্রবংশীয় রাজাদিগের উল্লেখ করা যায়,যারা ইন্দোনেশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলের রাজত্ব করেছিলেন। তাঁরা বুদ্ধধর্মের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁদের রাজত্বকালে নির্মিত বিশালাকার বোরোবুদুরের মন্দির,কলসান, চণ্ডীমেণ্ডুল ইত্যাদি স্থাপত্য কলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলো পাওয়া যায়। সেই সময় শৈলেন্দ্র রাজবংশের তথা সমগ্র ইন্দোনেশিয়ার সাথে ভারতবর্ষের অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
বলপুত্রের শৈলেন্দ্ররাজ বলপুত্রদের বুদ্ধধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবশত নালন্দায় ও নাগাপটন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বসবাসের নিমিত্তে যথাক্রমে পালরাজা ও চোল রাজদিগের রাজত্বকালে বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। এর ভরণ-পোষণের জন্য তৎকালীন পালরাজ দেবপালকে পাঁচটি গ্রাম দান করার অনুরোধ করেন। দেবপাল সেই অনুরোধ রক্ষা করেন। বাংলার পাল রাজাদের সঙ্গে শৈলেন্দ্র রাজাদের নিবিড় যোগসূত্র ছিল। এ বিষয়ে অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস জানার জন্য দুইটি মূল্যবান মহাযান গ্রন্থের উল্লেখ করা যায়,যথা : সং হ্যাং কমহয়নন মন্ত্রনয় (sang hyang kamahayanan Mantranaya) এবং সংহ্যা কমহয়নিকন (HCFE. 27. Sang hyang kamahayanikan)| উপর্যুক্ত মূল গ্রন্থ দুইটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত এবং তথায় বাংলাদেশির বুদ্ধধর্ম বা তান্ত্রিক বুদ্ধধর্ম নিয়ে আলোচনা রয়েছে (2500 years p.95276)|শেষোক্ত গ্রন্থটিতে জাভার তান্ত্রিক রাজা কৃতনগরের ১২৫৪-৯২ অব্দ) বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে (2500 years P.95)|ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঐতিহাসিক পুণ্যতীর্থ হলো ‘‘বোরোবুদুর বুদ্ধ মন্দির’’। ইন্দোনেশিয়ার যোগযাকার্তায় ৪২ কি.মি. উত্তর পশ্চিমে এবং মাগেলাং ৫ কি.মি. দূরে দক্ষিণ গোলার্ধের সবচেয়ে বড় মনুষ্য নির্মিত বৌদ্ধ ধর্মীয় কীর্তি ‘বোরোবুদুর বুদ্ধ মন্দির’অবস্থিত।
বড়বুদুর পাহাড়ের উপরে বিশাল সমতল পাথরের অবস্থিত, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ২৬৫ মি (৮৬৯ ফু) এবং এই এলাকার শুকিয়ে যাওয়া হ্রদ “পালো হ্রদ” থেকে উচ্চতা ১৫ মি (৪৯ ফু)। এই হ্রদ নিয়ে বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদদের মধ্যে মতবাদ লক্ষ্য করা যায়। ডাচ শিল্পী এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ স্থাপনা বিশেষজ্ঞ W.O.J. Nieuwenkamp একটি তত্ত্ব প্রবর্তন করেন। তত্ত্বটি হল, “কেদু প্লেইন” এক সময় হ্রদ ছিল এবং বড়বুদুর প্রধানত প্রতিনিধিত্ব করত হ্রদে ভাসমান পদ্ম ফুল।
এই মন্দিরটি কে অথবা কি উদ্দেশ্য স্থাপিত হয়েছিল, সে বিষয়ে কোন লিখিত দলিল পাওয়া যায় না। কিন্তু এই মন্দিরের ভূগর্ভস্থে নির্মিত পাথরের মূর্তি ও ৮ম ও ৯ম শতকে নির্মিত রাজকীয় চত্বরে মূর্তির কারুকাজের ধরন অনুযায়ী এই মন্দিরের নির্মাণকাল ধারণা করা যায়। এই অনুযায়ী বোরোবুদুর ৮০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে নির্মিত হয় বলে ধারনা করা যায়।এই স্থাপনাটি ৭৬০ থেকে ৮৩০ খ্রিষ্টাব্দ মধ্য জাভার সাইলেন্দ্রা সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে।এই মন্দিরটি নির্মাণ করতে আনুমানিক ৭৫ বছর অতবাহিত হয় এবং এই মন্দিরটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় ৮২৫ সালে সামারতুঙ্গার শাসনামলে।বুদ্ধ স্থাপনা, বড়বুদুরসহ, দেখতে অনেকটা হিন্দু শিব প্রমবন মন্দিরের মত। ৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে শিভাইত রাজা সঞ্জয় বড়বুদুর মন্দির কমপ্লেক্স থেকে মাত্র ১০ কিমি. পূর্বে ওকির পর্বতে শিবলিঙ্গ মন্দির স্থাপনের জন্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন।বড়বুদুর কয়েক শতাব্দী ধরে ক্রমবর্ধমান বনজঙ্গল ও আগ্নেয়গিরির ছায়ের স্তরে ঢাকা পড়ে। এই স্থাপনাটি পরিত্যক্ত হওয়ার পেছনের কারণ রুহস্যময়। ৯২৮ থেকে ১০০৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যকার যে কোন সময়ে, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরনের কারণে তৎকালীন রাজা এম্পু সিন্দক মেদাং রাজ্যের রাজধানী পূর্ব জাভায় স্থানান্তর করেন।কিন্তু এই কারণে যে মন্দিরকটি যে পরিত্যক্ত হয় তা সঠিকভাবে বলা যায় না, কিন্তু অনেক উৎসে মন্দিরটি পরিত্যাগের কারণ হিসেবে উক্ত ঘটনাটকে দায়ী করেন। সোয়েকামো (১৯৭৬) তিনি উল্লেখ করে যে, একটি প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে, ১৫ শতকে জনসংখ্যার অধিকাংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ফলে এই মন্দিরটি পরিত্যাগ করা হয়।
১৮১১ থেকে ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জাভা ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে থাকে। ব্রিটিশ সরকারের নিয়োগোপ্রাপ্ত গভর্নর লেফটেন্যান্ট গভর্নর-জেনারেল থমাস স্ট্যামফোর্ড র্যা ফলস, যিনি জাভার ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি জাভা’র ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত অনেক দুষ্প্রাপ্য জিনিস সংগ্রহ করেন এবং দ্বীপ তার পরিভ্রমণে তিনি স্থানীয় অনেক অধিবাসীর সাথে কথা বলে তা নোট করেন। ১৮১৪ সালের সেমারাং দ্বীপের এই পরিদর্শনে, তিনি বুমিসেগ্রো গ্রামের সন্নিকটে একটি বিশাল স্থাপনা সন্ধান পান, যা ঘন বনজঙ্গলে আবৃত। তিনি একা এই আবিষ্কারে সমর্থ ছিলেন না, তাই তিনি অনুসন্ধানের জন্য ডাচ প্রকৌশলী এইচ.সি.কর্নেলিয়াস’কে উক্ত স্থানে প্রেরণ করেন। দুই মাসের মধ্যে কর্নেলিয়াস এবং তার অধীনস্থ ২০০ জন লোক বন জঙ্গল কেটে, উদ্ভিদ আগুনে পুড়ে এবং মাটি খুড়ে এই স্থাপনাটি উদ্ধার করেন।
ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনা থাকায় তিনি স্থাপনার সব অংশ মাটি খুড়ে বের করতে পারেন নি। তিনি র্যানফলস’কে কারুকাজ সহ তার আবিষ্কারের প্রতিবেদন পেশ করেন। যদিও প্রতিবেদনটি কয়েক লাইনের, তবু র্যা ফলস এই স্থাপনাটি আবিষ্কারের সব কৃতিত্ব তাকে দেন, যা তাকে বিশ্ববাসীর নজরে আনে।এই স্থাপনাটির অনেক কারুশিল্প, উল্লেখযোগ্য হল সিংহ, কালা, মাকারা যা এখন ব্যাংককের জাতীয় যাদুঘরের জাভা শিল্পকলা কক্ষে প্রদর্শিত আছে।
১৮৮৫ সালে জেরমান যখন যোগিয়াকর্তা’র (জগজা) প্রত্নতত্ত্ব সোসাইটির সভাপতি ছিলেন তখন বড়বুদুর তার দৃষ্টি আকর্ষন করে। ১৯০২ সালে ব্রান্ডেস-একজন শিল্প ইতিহাসবিদ; দ্যডোর ভ্যান এর্প-ডাচ সেনাবাহিনী প্রকৌশলী কর্মকর্তা এবং ভ্যান ডি কামের-নির্মাণ প্রকৌশলী এর পুনরুদ্ধার কাজ পরিচালনা করেন। এই পুনরুদ্ধার কাজে অংশ নেয় ৪৮,৮০০ ডাচ লোক। তারপর পুনরুদ্ধার কাজ ১৯০৭-১৯১১ সাল পর্যন্ত স্থগিত থাকে। এই পুনরুদ্ধার কাজে ভ্যান এর্প আরেকটি প্রস্তাবনা দেন এবং যা সংগৃহীত হয় অতিরিক্ত ৩৪,৬০০ লোকের ব্যয়সহ। এর ফলে প্রথম দর্শনে বড়বুদুর তার সোনালী খ্যাতি পুনরুদ্ধার করে। অর্থ সংকটের কারণে এই মন্দিরের পুনরুদ্ধার কাজে শুধুমাত্র এর পরিষ্কারকরণের কাজে গুরুত্ব দেয়া হয়।১৯৬০ সালের শেষভাগে এই স্থাপনাটি বিশাল আকারে পুননির্মাণের জন্য ইন্দোনেশিয়ার সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরোধ জানায়। ১৯৭৩ সালে বড়বুদুর পুনরুদ্ধারের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা গৃহীত হয়।১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া সরকার ও ইউনেস্কো বিশাল পুনরুদ্ধারের কাজ পরিচালনা করে।এই স্থাপনাটি পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয় এবং এর ১৪৬০ প্যানেলের সবগুলোই পরিষ্কার করা হয়। এই কাজে অংশ নেয় ৬০০ মানুষ এবং এই কাজে মোট ব্যয় হয় $৬৯,০১,২৪৩।পুননির্মাণ শেষ হলে ১৯৯১ সালে ইউনেস্কো বড়বুদুর’কে বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসেবে তালিকাভূক্ত করে।
বড়বুদুর বৃহৎ একক বৌদ্ধস্তূপ হিসেবে স্থাপিত হয়। এই মন্দিরটির ভিত্তি বর্গাকৃতির, যার প্রত্যেকদিকের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১৮ মিটার (৩৮৭ ফু)। এটির নয়টি প্লাটফর্ম বা স্তর আছে। যার নিচের তিনটি বর্গাকৃতির এবং উপরের তিনটি গোলাকৃতির। উপরের স্তরটি বাহাত্তরটি ছোট বৌদ্ধস্তূপ দ্বারা বেষ্টিত একটি বৃহৎ বৌদ্ধস্তূপ যা উপরের স্তরকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। প্রত্যেকটি বৌদ্ধস্তূপ ঘন্টাকৃতির এবং কারুকার্যমন্ডিত।
এই দেয়ালগুলোতে অসংখ্য পাথুরে বৌদ্ধ ভাস্কর্য রয়েছে। ডাচ্ পণ্ডিতেরা খোদিত চিত্রের প্রতিলিপি ডাচ্ ভাষায় ছাপিয়ে এদের ভূমিকাও বর্ণনা দিয়েছেন। এই সব দেয়ালে অঙ্কিত আছে বুদ্ধজীবনের ঘটনা,জাতকের কাহিনী,ললিত বিস্তার গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী খোদিত চিত্র ও ভাস্কর্য। এ ছাড়া প্রদক্ষিণ পথের মাঝে মাঝে দেয়ালের কুলঙ্গীতে বহু বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব মূর্তি রয়েছে।
উপরের গোলাকার তিনটি স্তরে প্রত্যেকটির মাঝামাঝি স্তূপ রয়েছে। এগুলোর প্রত্যেকটির ভিতরে একটি করে ধ্যানাসনে উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। এই চৈত্যগুলোর গায়ে রুইতল তাসের আকারে ছোট ছোট ফাঁক রয়েছে। এই ফাঁকের মধ্যদিয়ে ভেতরে উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি দেখা যায়। সমগ্র স্তূপে বুদ্ধমূর্তির সংখ্যা হবে সুনীতি কুমার চট্টোপধ্যায় এর মতে ৫০০ এর উপর (দীপময় ভারত),নির্মল কুমার ঘোষের মতে ৪৩২টি (ভারত শিল্প,প্রবন্ধ সম্ভার- সলিল বিহারী বড়ুয়া,চট্টগ্রাম,১৯৯৯,পৃ: ৭৭)।
প্রধান গম্ভুজটি সবচেয়ে উঁচু প্লাটফরমে এবং স্তূপের ভিতর ৭২টি বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। প্রথম ১৬০টি খোদিত প্যানেলে চিত্রিত করে বর্ণনা করা হয়েছে, কামধাতু অর্থাৎ মানবের কামনা বাসনা, হাঁসি কান্না। পরবর্তী পাঁচটি স্তরে ১২০০টি খোদিত ভাস্কর্যের মাধ্যমে বুদ্ধের জীবনী ও ৪০টি বোধিসত্ত্বের জীবনীর মাধ্যমে পার্থিব কামনা বাসনা ও মোহ মুক্তির উপায় সম্বন্ধে বিশদভাবে রূপধাতুকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। সর্বোপরি তিনটি গোলাকার সমতল ছাঁদে ৭২টি স্তূপের প্রতিটিতে একটি করে বুদ্ধমূর্তি রয়েছে।
দেশি-বিদেশি তীর্থ যাত্রীদের উপরে উঠার সিঁড়ির ধাপ,বারান্দা,দেওয়াল,রেলিং ও স্তম্ভ ১৪৬০টি বর্ণনামূলক রিলিপ প্যানেল দ্বারা সজ্জিত। পূর্বদিকের প্রধান ফটক হতে প্রধান স্তূপ পর্যন্ত তীর্থ যাত্রীদের পাঁচ কি.মি. পথ অতিক্রম করার পথে বুদ্ধ ও বুদ্ধবাণীর ১৫০০টি রিলিপ প্যানেল রয়েছে (প্রবন্ধ সম্ভার,ডা: অনিল বড়ুয়া,চট্টগ্রাম,২০০৯,পৃ. ৩৮)।
বোরোবুদুর স্তূপটি চতুর্ভূজ আকারবিশিষ্ট সমতল হতে উত্থিত হয়ে উপরিভাগ স্তূপাকৃতি। এর ভেতরে খালি স্থান নেই,উপরিভাগ আচ্ছাদন বিহীন,চতুর্দিক ও উপরিভাগ আকাশের দিকে উন্মুক্ত। নিুভাগের মেঝ চতুষ্কোণ ও প্রতিটি ভাগ ৩৭০ ফিট লম্বা। দ্বিতীয় ভাগ ২৩ (তেইশ) ফিট। এতে ৫টি ধাপ রয়েছে। প্রতিটি ধাপের আকার নীচ থেকে উপরের দিকে ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে গেছে। নিম্নের দিকে মানবের প্রতিদিনকার নিয়মিত ঘটনাবলী চিত্রাদিও ভাস্কর্য সম্বলিত। ‘ল অব কর্ম’বা কর্মফলকে বর্ণনামূলক চিত্রও ভাস্কর্য দিয়ে প্রতিফলিত করা হয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে বুদ্ধের পূর্বজন্মের ঘটনাবলী সম্বলিত জাতকের গল্প ও সিদ্ধার্থ গৌতমের জীবনীর উপর ১২০টি ভাস্কর্য (প্রবন্ধ সম্ভার,ডা: অনিল বড়ুয়া,চট্টগ্রাম,২০০৯,পৃ. ৩৯)।
বরোবুদুর এখনও একটি তীর্থস্থল হিসেবে পরিগণিত হয়। ইন্দোনেশিয়ার বৌদ্ধরা বছরে একবার এখানে বেশাখ উৎসব উদযাপন করেন। বরোবুদুর ইন্দোনেশিয়ার একক সর্বাধিক পরিদর্শিত পর্যটন কেন্দ্র। এ বোরোবুদুর বৌদ্ধ স্থাপত্য ও শিল্পকলার ইতিহাসে বিস্ময়কর নয়নাভিরাম শিল্পকর্ম। বুদ্ধধর্মের একান্ত পৃষ্ঠপোষক শৈলেন্দ্র রাজাদের অবিস্মরণীয় শ্রেষ্ঠকীর্তি ‘বোরোবুদুর বুদ্ধ মন্দির’ ইতিহাসে উজ্জ্বলতম স্থানে অবস্থান করে আছে।