কম্বোডিয়ার আঙ্কোর ভাট মন্দিরটি পৃথিবীর বৃহত্তম মন্দির হিসেবে খ্যাত। রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন এই মন্দির। তবে আশ্চর্যের বিষয়, বংশ পরম্পরা অনুসারে তাঁরা শিবের উপাসক হলেও, এই মন্দিরটি রাজা উত্সর্গ করেছিলেন ভগবান বিষ্ণুকে। মন্দিরের স্থাপত্যে রয়েছে দ্রাবিড়ীয় শৈলীর ছাপ। দেওয়ালের গায়ে রয়েছে অজস্র হিন্দু দেবদেবীর প্রতিকৃতি। মন্দির প্রতিষ্ঠাকালের সময়কার কোনও তথ্যই ঐতিহাসিকরা খুঁজে বের করতে পারেননি তেমন ভাবে। তাই এই মন্দিরের তত্কালীন নাম নিয়ে একটা ধোঁয়াশা আজও রয়ে গিয়েছে। অনেকের বিশ্বাস ‘বরাহ বিষ্ণুলোক’ নামে পরিচিত ছিল এই মন্দির।
“এটি একটি অসাধারণ স্থাপনা”, ১৫৮৯ সালে পর্তুগিজ সন্ন্যাসী অ্যান্তনিও দ্য ম্যাডেলেনা তৎকালীন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ডিওগো ডো কুটোর কাছে এভাবেই কম্বোডিয়ার ‘অ্যাঙ্কর ওয়াট’ -এর বর্ণনা দেন। অ্যান্তনিও দ্য ম্যাডেলেনা হলেন পশ্চিমা দেশ থেকে আগত পর্যটকদের মধ্যে সবার আগে ১২ শতকের এই হিন্দু-বৌদ্ধ মন্দির পরিদর্শনকারীদের মধ্যে অন্যতম একজন। তিনি আরও বলেন, “এটি এমন এক সৃষ্টি যা লিখে বোঝানো বা বলা সম্ভব নয়। এরকম বিস্ময়কর নিদর্শন পৃথিবীতে বিরল। কোনো মন্দিরের মিনার, সাজসজ্জা ও পরিমার্জনা যে এত সুন্দর হওয়া সম্ভব তা একজন মানুষের কল্পনার বাইরে”।কম্বোডিয়ার সিয়েম রিপে অবস্থিত ‘অ্যাঙ্কর ওয়াট’ পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্মীয় কীর্তিস্তম্ভের একটি। কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রীয় ভাষা খেমারে ‘অ্যাঙ্কর ওয়াট’ এর অর্থ ‘মন্দিরের শহর’। তবে ১২ শতকে যখন এর নির্মাণ হয়, তখন এর নাম অন্য কিছু ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় ধর্মীয় স্থাপনার নির্মাণকাজ ছিল এই অ্যাঙ্কর ওয়াটের নির্মাণ এবং এর পেছনে যে সম্রাট দ্বিতীয় সূর্যভার্মানের কৃতিত্ব রয়েছে তা-ও সবার জানা আছে, তবুও ইতিহাসের পাতায় এই মন্দিরের কোনো নামের উল্লেখ ছিল না। রহস্যজনকভাবে এর নাম অজানাই রয়ে গেছে।
খেমার স্থাপত্যের এই উৎকৃষ্ট সৃষ্টি মূলত দুটি অংশে বিভক্ত। একটি অংশ অনেকটা পর্বতের ন্যায় এবং আরেকটি অংশ গ্যালারির মতো। পর্বতের অংশ দ্বারা মেরু পর্বতকে মূলত বোঝানো হয়। ৩.৬ কিলোমিটারের একটি দেয়াল এই মন্দিরের চারপাশে রয়েছে এবং সমগ্র মন্দির একটি পরিখার মাঝে সীমাবদ্ধ। মন্দিরের কেন্দ্রে রয়েছে কুইনসানক্স টাওয়ার। অ্যাঙ্কর ওয়াটের নকশা মূলত মাউন্ট মেরু তথা হিন্দু দেবতাদের পৌরাণিক আবাসস্থলের মতো নির্মিত। মাউন্ট মেরুকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ‘বিশ্বের কেন্দ্র’ বলে বিশ্বাস করেন।হিন্দুধর্মে তিনজন প্রধান দেবতা আছেন, যারা হলেন- শিব, বিষ্ণু এবং ব্রহ্মা। এর মধ্যে বিষ্ণু ‘রক্ষক’ বা ‘প্রতিপালক’ হিসেবে পরিচিত। তার প্রতি উৎসর্গ করেই উক্ত মন্দিরটি নির্মিত হয়। মন্দিরটি নির্মাণের পেছনে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব ছিল সম্রাট দ্বিতীয় সূর্যভার্মানের, যার নামের অর্থ সূর্যের রক্ষক। অনেকের মতে, অ্যাঙ্কর ওয়াট শুধু দেবতার প্রতি উৎসর্গের জন্যই নয়, বরং সম্রাটের সমাধিস্তম্ভ হিসেবে ব্যবহারের জন্যও নির্মিত হয়।
প্রচলিত মত অনুসারে, তৎকালীন সম্রাট ধারানিন্দ্রভার্মান যখন হাতির পিঠে চড়ে ভ্রমণ করছিলেন, তখন তার এক নিকটাত্মীয় তাকে ক্ষমতার লোভে হত্যা করেন এবং জোরপূর্বক ক্ষমতায় আসেন। সেই ব্যক্তিই হলেন সম্রাট দ্বিতীয় সূর্যভার্মান। এক লিপি অনুসারে, সূর্যভার্মান তাকে এমনভাবে হত্যা করেন, যেভাবে পর্বতের গরুর (একটি কাল্পনিক পাখি) একটি সাপকে হত্যা করে। উক্ত সম্রাটের দখলদারী মানসিকতার জের ধরে তিনি ভিয়েতনামের সমগ্র এলাকা নিজের আওতায় আনার প্রচেষ্টা চালান। তিনি চীনের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করে খুব চতুরতার সাথে সেই দেশকে দখল করতে চান। তার চরিত্রে অসংখ্য দোষ থাকলেও তিনি ছিলেন খুব ধার্মিক, দেবতা বিষ্ণুর পরম ভক্ত (কিন্তু বংশগত ভাবে তারা ছিল শিবের উপাসক)।
সর্বদাই তিনি বিষ্ণুদেবের পূজা করতেন এবং অ্যাঙ্কর ওয়াটের কেন্দ্রীয় মিনারে তাঁর একটি মূর্তিও সম্রাটের আদেশে স্থাপন করা হয়। মন্দিরটির প্রত্যেক অংশে তার ভক্তির নিদর্শন দেখা যায়। সম্রাট সূর্যভার্মানকে তার মৃত্যুর পর এই ভক্তির জন্য ‘পরমবিষ্ণুলোক’ উপাধি দেওয়া হয়। গবেষক হেলেন লিজেন্দ্রে দে কোনিকের মতে, এর মানে ‘সেই ব্যক্তি যে বিষ্ণু দেবের সর্বোত্তম গৃহে বাস করে’। ১১১৬ সালে রাজা সূর্যভার্মান সিংহাসনে আসলে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। এই কাজের সমাপ্তি ঘটে ১১৫০ সালে, রাজা সূর্যভার্মানের মৃত্যুরও অনেক পরে। খেমার সম্রাটেরা নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব পোক্ত করার জন্য এবং তাদের উপর দেবতাদের আশীর্বাদ রয়েছে তা বোঝানোর জন্য মন্দিরের বেশ কয়েকটি ভবন নির্মাণ করেন।হিন্দু মন্দিরগুলো শুধু ধর্মীয় উপসনালয় হিসেবেই নয়, একই সাথে দেবতাদের গৃহ হিসেবেও ব্যাখা করা হয়। কম্বোডিয়ার সম্রাটেরা আরেকটি বিশ্বাস সবার মধ্যে জাগ্রত করতে চান। তার পূর্বসূরী কিংবা তার শত্রুদের উপর নয়, বরং তার উপর যে দেবতারা বেশি সন্তুষ্ট তা বোঝাতেই সব রাজাই পূর্বের সম্রাটের তুলনায় অধিক চমৎকার মন্দিরের ভবন গঠনের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে কম্বোডিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ঘটে। ফলে ১৪শ বা ১৫শ শতাব্দীতে আঙ্করভাট বৌদ্ধ মন্দিরে পরিণত হয়, যা আজ পর্যন্ত বজায় আছে। আংকরের অন্যান্য মন্দিরের সাথে এর আরেকটি পার্থক্য হল – যদিও ১৬শ শতাব্দীর পরে এটি কিছুটা অবহেলিত হয়, তথাপি অন্যান্য মন্দিরের মতো এটি কখনোই পরিত্যক্ত হয় নাই। চারদিকে পরিখা থাকায় বন জঙ্গলের গ্রাস থেকে মন্দিরটি রক্ষা পায়। এসময় মন্দিরটি সূর্যবর্মণের মরণোত্তর উপাধি অণুসারে প্রিয়াহ পিস্নুলোক নামে পরিচিত ছিল। আধুনিক নামটি, অর্থাৎ আঙ্করভাট নামটির ব্যবহার ১৬শ শতাব্দী হতে শুরু হয়। এই নামটির অর্থ হল নগর মন্দির। আংকর শব্দটি এসেছে নগর শব্দ হতে, যা আসলে সংস্কৃত শব্দ নগর এর অপভ্রংশ। আর ওয়ত হল খ্মের ভাষার শব্দ যার অর্থ মন্দির। আংকর ওয়তের মন্দিরটি এর স্থাপত্যকলার সৌন্দর্যের জন্য প্রশংসিত। এর সাথে প্রাচীন গ্রিস বা প্রাচীন রোমের স্থাপত্য কলার তুলনা করা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আংকরের সংরক্ষণকারী মরিস গ্লেইজের মতে,
“It attains a classic perfection by the restrained monumentality of its finely balanced elements and the precise arrangement of its proportions. It is a work of power, unity and style.”
সাধারণত মন্দিরের অবস্থান পূর্বদিকে মুখ করা থাকলেও অ্যাঙ্কর ওয়াট পশ্চিম দিকে মুখ করে অবস্থিত। বিশেষজ্ঞরা এজন্য বিভিন্ন যুক্তি ও ব্যাখা দিয়েছেন। হিন্দু ধর্ম মতে, বিষ্ণু হলেন সকল দেবতা হতে সবচেয়ে উত্তম এবং তিনি তাদের সামনে অবস্থান করেন। বাকি দেবতাদের অবস্থান যেহেতু পূর্বে এবং উক্ত মন্দিরটি বিষ্ণুদেবের জন্যই নির্মিত, সেহেতু তার উদ্দেশ্যেই এই মন্দিরের অবস্থান এরকম। আবার হিন্দু ধর্মানুসারে, পূর্বদিকের সাথে মৃত্যুর বিষয়টিও জড়িত। সূর্যভার্মান যখন প্রথম এর নির্মাণকাজ শুরু করেন, তখন তিনি তার সমাধি তৈরির নির্দেশও দেন।হয়তো তার বিশ্বাস ছিল, পূর্বমুখী না হয়ে তার সমাধি যদি পশ্চিমমুখী হয়, তাহলে তার অমর হওয়ার বা পরপারেও রাজত্ব করার সুযোগ থাকবে। তবে কারণ এটাই ছিল নাকি তা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্কও আছে। অবশ্য কারণ যা-ই হোক না কেন, পশ্চিম দিকে মুখ করে এর অবস্থানের কারণে অসাধারণ সূর্যাস্তের যে দৃশ্য দেখা যায় তা ভোলার মতো নয়।(মন্দিরের গঠন স্থাপত্য নিয়ে কিছু লিখছি না কেননা এটা আমি বুঝিওনা আর পাঠকবৃন্দরা বোরিং ফিল করবেন, তাই যদি কেও পড়তে চান বিশদে নিচে তথ্যসূত্র এ Wikipedia লিঙ্ক দেখতে পারেন)
আংকোর ভাটের মন্দিরগাত্রে কয়েক হাজার ভাস্কর্য রয়েছে। তার মধ্যে একটিতে পিঠে কাঁটাওয়ালা তৃণভোজী ডাইনোসর স্টোগোসরাসের প্রতিকৃতি দেখা যায়। প্রসঙ্গত, স্টেগোসরাসের জীবাশ্ম প্রথম আবিস্কৃত হয় মার্কন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোয় ১৮৭৭ সালে।
তাহলে প্রশ্ন হল, তারও ছশো বছর আগে কী করে মানুষের তক্ষণে উঠে এল ডায়ানোসরের অবয়ব?শুধুই কল্পনা?নাকি সে যুগেও আবিষ্কৃত হয়েছিল অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক কোনও জীবাশ্ম?যা দেখে আমাদের পূর্বসুরীরা ভেবে নিয়েছিল কেমন দেখতে ছিল ওই প্রাণীরা?তারপর রূপ দিয়েছিল ছেনি বাটালি হাতুড়ির মাধ্যমে | সেই রহস্যের উপর থেকে পর্দা আজও ওঠেনি | কেবল আঙ্কোরভাট দাঁড়িয়ে আছে বিস্ময়ের ভাণ্ডার নিয়ে |(মন্দিরে পাওয়া ডায়ানোসরের ছবি নিচে দেওয়া আছে)
১৯৯০ এর দশক হতে আংকর ওয়তের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার কার্যক্রম আবার শুরু হয়। এর সাথে সাথে শুরু হয় পর্যটনশিল্প। ভারতের পুরাতাত্তিক সংস্থা ১৯৮৬ হতে ১৯৯২ সালের মধ্যে মন্দিরটিতে সংস্কারের কাজ করে। মন্দিরটি আংকরের বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসাবে ইউনেস্কো কর্তৃক ১৯৯২ সালে স্বীকৃত হয়। এতে করে মন্দিরের সংস্কারের জন্য অর্থায়ন ও কম্বোডিয়া সরকারের দ্বারা মন্দিরের সুরক্ষার কার্যক্রম সহজতর হয়েছে। জার্মানির অপ্সরা সংরক্ষণ প্রকল্প এই মন্দিরের অপ্সরা ও দেবতাদের ছবি সংবলিত কারুকার্যমন্ডিত দেয়ালের নকশাকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করছে। সংস্থাটির সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রাকৃতিকভাবেই পাথর ক্ষয়ে যাওয়ায় দেবতামূর্তিগুলির ২০ শতাংশেরই খুব করুণ দশা। তার উপরে শুরুর দিকের সংরক্ষণকারীদের অনভিজ্ঞতার ফলেও অনেক ক্ষতি হয়েছে। সংস্কার কার্যের অন্যান্য দিকের মধ্যে রয়েছে ধ্সে যাওয়া অংশ মেরামত। যেমন, উপরের স্তরের পশ্চিম দিকের ২০০২ সাল থেকেই খুঁটি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে।জাপানি বিশেষজ্ঞ্ররা ২০০৫ সালে উত্তর দিকের পাঠাগার মেরামত করেছেন।
কম্বোডিয়ায় এই মন্দিরটি এতটাই সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় যে, এই দেশের জাতীয় পতাকায় এই অ্যাঙ্কর ওয়াট চিত্রিত রয়েছে। দেশটির প্রধান পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে একটি হলো এই মন্দিরটি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পর্যটন ওয়েবসাইট ‘ট্রিপঅ্যাডভাইজর’ এর মতে, এটি বিশ্বের সুন্দরতম নিদর্শনগুলোর একটি এবং কম্বোডিয়ার সিয়েম রিপে দেখার মতো সর্বোত্তম স্থান।