পৃথিবীর আজব শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম সেন্ট্রাল সাইবেরিয়ার একটি ছোট্ট শহর অয়মিয়াকন। এই শহরটির তাপমাত্রা ডিপ ফ্রিজের তাপমাত্রার তিন গুণেরও বেশি। এখানে তাপমাত্রা এতই ঠান্ডা যে ফুটন্ত গরম জল শূন্যে ছুড়ে দিলে মাটিতে পড়ার আগেই তা জমে বরফ হয়ে যায়।
রাশিয়ার উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত অয়মিয়াকস্কি জেলার এক পৌরশহর অয়মিয়াকন। অয়মিয়াকন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৭০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত কিন্তু এর এত শীতল হবার কারণ হলো ভূ প্রকৃতির এক বিশেষ অবস্থান। এর আশেপাশে কোনো সমুদ্র না থাকার জন্য চরমভাবাপন্ন শীতল তাপমাত্রা প্রশমিত হতে পারে না এবং এ বসতি উপত্যকার অত্যন্ত নিচের দিকে অবস্থিত । দুটি অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানকার ঠান্ডা বাইরে যেতে পারে না।
অয়মিয়াকন নদীর নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। সাইবেরিয়ান আঞ্চলিক ভাষায় অয়মিয়াকন অর্থ আনফ্রজেন ওয়াটার বা যে জল কখনো জমে যায় না। এ নদীর তলদেশে প্রাকৃতিক উষ্ণ পানির প্রবাহ থাকায় নদীর উপরে জল জমে বরফ হয়ে গেলেও নিচে সে উষ্ণ জল সব সময় তরল অবস্থায় থাকে। অত্যন্ত ঠান্ডার কারণে অয়মিয়াকনকে বলা হয় পোল অফ কোল্ড।
এখানে শুধু হাড় হিম করা ঠান্ডাই নয় এটি অত্যন্ত দুর্গম ও বটে। অয়মিয়াকন এর সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর থেকে এখানে পৌঁছতে সময় লাগে টানা দুই দিন দুই রাত। বরফের উপর বরফের আস্তরণ জমে এ রাস্তা কাচের মত পিচ্ছিল হয়ে থাকে। সামান্য একটু এদিক-সেদিক হলেই নিশ্চিত বিপদ। ২০১১ সালে বিবিসিতে প্রচারিত একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে এই রাস্তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক রাস্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
সোভিয়েত আমলের জোসেফ স্টালিন তৎকালীন রাজনৈতিক বন্দীদেরকে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে এই রাস্তা তৈরি করেন। চরম প্রতিকূল আবহাওয়ায় এই রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে প্রায় দশ লক্ষেরও বেশি লোক মারা গেছে। কাজ করতে করতে যারা মারা যেতো তাদেরকে রাস্তার মধ্যেই সমাহিত করা হয়। এজন্য এই রাস্তাকে বলা হয় রোড অফ বোন্স বা হাড় দিয়ে তৈরি রাস্তা।
বিগত প্রায় শত বছর ধরে অয়মিয়াকনের বাসিন্দারা একই রকম জীবন-যাপন করে আসছে। এখানে খাবার জলের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। এখানে কোনো জলের সরবরাহ নেই পাইপের ভেতরে পানি প্রবাহিত হবার আগেই তা জমে বরফ হয়ে যায়।
কারণ ডিপ ফ্রিজের চেয়েও তিনগুণ বেশি ঠান্ডায় জল তরল থাকার কথা না, আর সেজন্যই ঘর গরম রাখার জন্য যে কাঠ পোড়ানো হয় সেখানেই তারা মিশিয়ে দেয় বরফের টুকরো। এই বরফ গলে যে জল উৎপন্ন হয় তাই তারা পান করে। শুধু জল নয় প্রতিদিনের খাবার যোগাড় করাও এখানে বেশ কষ্টের।
অয়মিয়াকন বাসিন্দাদের প্রধান খাবার হল ঘোড়ার মাংস আর তাই এই ঘোড়াগুলো স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এখানকার ঘোড়াগুলো এই চরমভাবাপন্ন তাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে । তারা ২৪ ঘণ্টা খোলা পরিবেশে থাকে তবে একটা ঝামেলা তা হলো এসব ঘোড়ার শরীরের বাইরের অংশে বরফ জমে যায় আর তাই ঘোড়াগুলোকে সুস্থ রাখতে অত্যন্ত শক্ত চিরুনি দিয়ে নিয়মিত তাদের শরীর থেকে বরফ ছাড়াতে হয়।
গ্রীষ্মকালে অয়মিয়াকনের এর দৈর্ঘ্য থাকে প্রায় ২১ ঘণ্টা আর শীতকালে এখানকার দিনের দৈর্ঘ্য হয় মাত্র তিন ঘণ্টা। সে সময় তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি নিচে নেমে গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা খুব অসুবিধায় পড়ে যায়। কারণ এই তাপমাত্রায় ফ্রস্ট বাইট হবার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি।
ফ্রস্ট বাইট হল প্রচন্ড ঠান্ডায় শরীরের অনাবৃত কোনো স্থানে রক্ত জমাট বেধে যাওয়া। শরীরের কোনো অংশে ফ্রস্ট বাইট হলে আক্রান্ত কোষ গুলো ধীরে ধীরে শরীর থেকে খসে পড়ে। তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি নিচে নেমে গেলে বাড়ির বাইরে বের হওয়াটা অনিরাপদ মনে করা হয়। সে সময় এখানকার একমাত্র স্কুলটিও ছুটি দিয়ে দেয়া হয়।
এখানে কোনো খাবার বা ফলমূল জমে এতই শক্ত হয়ে যায় যে তার খাবার উপযোগী থাকে না। অয়মিয়াকনের জমে যাওয়া কলা দিয়ে অনায়াসে হাতুড়ির কাজ করতে পারবেন। শীতকালে কাপড় কাচার কথা ভাবাও যায় না কারণ ফুটন্ত গরম জল দিয়ে কাপড় ধুলেও তার জমে এমন শক্ত হয়ে যায় যে কাপড় ব্যবহার উপযোগী থাকে না। ১৯২০ সালের অয়মিয়াকনে -৭২ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যা স্থায়ী বসতি পূর্ণ কোনো এলাকায় রেকর্ড করা পৃথিবীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। আর তাই একে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল শহর।
জেলেরা তাদের বলগা হরিণের টানা গাড়িতে চড়ে স্থানীয় নদীতে মাছ শিকার করতে যায়। নদীগুলো শীতকালে পুরোপুরি জমে বরফ হয়ে থাকে তবুও মাছ খুঁজে পেতে জেলেদের একটুও কষ্ট করতে হয় না। কারণ মাছের সন্ধানে স্থানীয় ঈগলপাখি আগেই গর্ত করে রাখে। জেলেরা শুধু সেসব ঘরে মাছ সংগ্রহ করে।
সেজন্য জেলেদের দরকার পড়ে অন্তত দুটি ঘর। এ ঘর থেকে ওপারে ঘর জাল বিছিয়ে সহজেই প্রচুর মাছ ধরা যায় নদী থেকে। উপরে তোলার পর সঙ্গে সঙ্গে মাছ জমে বরফ হয়ে যায়। স্থানীয়দের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে অয়মিয়াকন তৈরির সময় সৃষ্টিকর্তার হাত ঠান্ডায় জমে গিয়েছিল আর তাই তার হাত ফসকে এখানে প্রচুর সম্পদ দিয়ে দেন।
বিগত কয়েক দশকে অয়মিয়াকন এর জনসংখ্যা কমে গেছে ব্যাপক হারে। বর্তমানে ছোট এই পৌর শহরে প্রায় ৫০০ থেকে ৯০০ জন লোক বাস করে। এ জনসংখ্যার মধ্যে কোনো লম্বা মানুষ নেই । বরং এখানে নিয়মিত যারা বাস করে তারা দিন দিন আরো খাটো হয়ে যাচ্ছে। তাই অয়মিয়াকনকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডিপফ্রিজে থেকেও বেশি কিছু বলা যেতে পারে।সংগৃহীত