আয়তনের দিক থেকে কলকাতার পরেই রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হিসাবে আসানসোল সর্বাধিক পরিচিত জনবহুল এলাকা। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের উষ্ণতম অঞ্চল হিসাবে আসানসোলের নাম ভূগোলের পাতায় পাতায়, গ্রীষ্মকালে যার তাপমাত্রা 40° সেলসিয়াস ছাপিয়ে যায়। শহরটির অর্থনৈতিক দিক যথেষ্ট উন্নত ও সাফল্যমণ্ডিত। এটি মূলত শিল্পাঞ্চল ভূমি, তাই এর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটি মূলত শিল্পকেন্দ্রিক। এ রাজ্যের কয়লা উত্তোলনের প্রধান ভূমি হিসেবে সমগ্র আসানসোলের ভূ-গর্ভস্থ অঞ্চল খুবই মূল্যবান ক্ষেত্র।
পাশাপাশি লৌহ-ইস্পাত শিল্পের কারিগরী দক্ষতাতেও আসানসোল যথেষ্ট এগিয়ে। এসবকিছুর নিদর্শন আসানসোলের কোনায় কোনায় -আসানসোলের কুলটিতে IISCO ইস্পাত কারখানাটি ভারতের প্রথম উন্নত শ্রেণির শিল্প কারখানা, 1960-70 সালে এই কোম্পানি আরও বিকাশ লাভ করে, দেশের সর্বত্র এমনকি দেশের বাইরের বিভিন্ন শহর থেকে এই শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয়। আসানসোল বাসীর কাছে ইস্কোর কালো ধোঁয়া এক Landmark স্বরূপ।উৎপাদনের আর এক নিদর্শন সেনরেলের সাইকেল কারখানা।
ইস্কো ছাড়াও রয়েছে ডিসেরগড় পাওয়ার সাপ্লাই,দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন, পূর্ব রেলের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা বার্ন কোম্পানি, হিন্দুস্থান কেবেল লিমিটেড আর বার্নপুরের সেই সিমেন্ট ফ্যাক্টারি ও উষাগ্রামের গ্লাস ফ্যাক্টারি। সবকিছু একই শহর আসানসোল-কে ঘিরে। এছাড়াও ব্যাবসা-বাণিজ্যের পসারেও আসানসোল শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। রেডিমেড ও গারমেন্টস পোশাকের বিপুল সম্ভারে এখানকার বড় বড় দোকান ও শপিংমলগুলি বৈচিত্র্যপূর্ণ। এক্সক্লুসিভ কালেকশনের- খোঁজে আসানসোলর পাশাপাশি রানীগঞ্জ এমনকি দুর্গাপুরবাসীও এখন আর কলকাতা ছোঁটে না, কেননা বাজার কলকাতা তো এখন আসানসোলেই। শুধুমাত্র পোশাকের আধুনিকতার ব্যাপারেই আসানসোলের বিশিষ্টতা সীমাবদ্ধ নয়, সাথে সবধরণের আধুনিকীকরনের সরঞ্জামের জন্য রয়েছে স্পেশাল শো-রুম।
প্রযুক্তিগত দিকটির থেকে চোখ সরিয়ে আমরা যদি শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে দেখব এখানকার সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বেশ উল্লেখযোগ্য এবং নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় বহনকারী। কচিকাচাদের পড়ার জন্য তো রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক স্কুলের পাশাপাশি প্রচুর ইংলিশ মিডিয়াম কো-এড স্কুল। বালক-বালিকাদের জন্য উচ্চবিদ্যালয়ের নাম তো হাতে গুণে শেষ করা যাবে না। তারমধ্যে প্রধান কয়েকটি হল- রামকৃষ্ণ মিশন, উষাগ্রাম হাইস্কুল, মণিমালা গার্লস, মহিলা কল্যাণ, আসানসোল নর্থ পয়েন্ট, Assembly of God Church School in Asansol & Sodpur, St. Patrick’s Higher Secondary School, Loreto Convent, Delhi Public School….. এরকম আরো অনেক।
এছাড়াও তরুণ-তরুণীদের জন্য রয়েছে প্রচুর কো-এড ও গার্লস কলেজ। কলেজের কথা বলতে গেলে প্রথম সারির মহাবিদ্যালয় হিসাবে আসানসোল বি.বি কলেজের কথা সবার আগে মাথায় আসে।এছাড়াও আছে আসানসোল গার্লস, বি.সি কলেজ,দেশবন্ধু মহাবিদ্যালয়। বর্তমানে আসানসোলের কাল্লা অঞ্চলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে,যার নাম কাজী নজরুল ইউনিভার্সিটি। আগে এ অঞ্চলের যে সমস্ত কলেজগুলি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ছিল সেগুলি এখন কাজী নজরুল ইউনিভার্সিটি অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। উচ্চশিক্ষার জন্য এখন আর প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রীদের বর্ধমান বা অন্যান্য ইউনিভার্সিটি ছুটে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। অনেক স্নাতক-উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীর এবারে রেগুলারে এম.এ, এম.এসসি বা এম.কম করার স্বপ্ন পূরণ হবে। এছাড়াও আসানসোলের বিভিন্ন জায়গায় পাঠকদের জন্য নির্মিত হয়েছে সাধারণ গ্রন্থাগার, বইপ্রেমিকদের কাছে এই ধরনের পাঠাগার অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র।
অন্যদিকে আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের জন্মস্থান হওয়ায় আসানসোলের গরিমাকে বহুমাত্রিকতা দান করেছে।
খেলাধূলোর কথা ভাবতে গেলে আসানসোলের পোলো গ্রাউন্ডের কথা সবার প্রথমে মাথায় আসে। পোলো খেলা থেকেই এই গ্রাউন্ডের নামকরন হয়, ব্রিটিশদের অধীনে থাকাকালীন এই পোলো গ্রাউন্ডের জন্ম হয়।তাছাড়াও আসানসোলের ইন্ডোর স্টেডিয়াম এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, যেখানে 500 জন দর্শক অনায়াসে উপস্থিত থাকতে পারে। উপরন্তু বার্নপুরের ক্রিকেট ক্লাব গ্রাউণ্ড হল এক উন্নত ক্রিকেট স্টেডিয়াম।
আসানসোলের রেলস্টেশনটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যস্ততম। বহু উন্নত স্টেশনের বৈশিষ্ট্যগুলি এখানে বিরাজমান। বর্তমানে এর প্ল্যার্টফর্ম সংখ্যা 7, রেলওয়ে পরিষেবার পাশাপাশি এখানকার পাবলিক বাস পরিষেবাও যথেষ্ট উন্নমিত।এই বাস স্ট্যান্ড থেকে সমস্ত রুটের বাস যাতাযাতের ব্যবস্থা আছে। তাই এই বাসস্ট্যান্ডটির আয়তনটিও বেশ বড়সড়। এরপরও যানজটকে সামাল দিতে বহুল পরিমানে অটো এবং টোটোর অবাধ ঘোরাফেরা লক্ষ করা যায়। তাছাড়াও আসানসোলের নিকটবর্তী 25 কিলোমিটারের মধ্যে অন্ডালে রয়েছে আন্তর্জাতিক স্তরের কাজী নজরুল ইসলাম বিমানবন্দরটি।
আসানসোলের গসিপ, আড্ডা বা সময়কে নিদারুণ ভাবে উপভোগ করার জন্য এককথায় ডেটিং ও গেট টুগেদারের কথা বলতে গেলে চোখ বন্ধ করেও আমাদের মন পৌঁছে যায় বার্নপুরের গ্যালাক্সিতে। আর একদিকে সৃষ্টি নগরের সেনট্রাম মলটির সৌন্দর্যায়নও মানুষকে আকর্ষণ করে। এছাড়া আসানসোলের বহু প্রাচীন শতাব্দী ও নেহেরু পার্কে ভ্যালেনটাইনস্ ডে-ই হোক বা ফ্রেন্ডস্ ডে ,বছরের 365 টা দিনই Young Generation-দের অপার উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো।শহরের দুটি বিখ্যাত সাংস্কৃতিক মঞ্চ রবীন্দ্রভবন ও ভারতী ভবন বহু সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের মিলনস্থল। হুল্লোড়ের খাতিরেই হোক বা প্রেম করার তাগিদে টিউশনি ফাঁকি দিয়ে অথবা কলেজ বাঙ্ক করে চিত্রা কিংবা মনোজে সিনেমা দেখার মজা উপভোগ করেনি, এরকম ছেলেমেয়ের সংখ্যা খুবই কম।
আমরা খাওয়া দাওয়ার প্রতি বিশেষভাবে যত্নশীল। তাই কোনো কারনেই একবার আসানসোল বাজার যাওয়া মানে মাধুরির ছোলাবটোরা খাওয়ার তাগিদে আমরা কম-বেশি সকলেই কুপোকাত। তার সাথে রয়েলের চিকেন আর রঞ্জন কেবিনের রসমালাই কিংবা কোর্ট মোড়ের জিতেনের লস্যি’র টেস্ট একবার নেওয়া মানেই বারবার সেই পথে মোড় নেওয়া। এই শহরটিও পর্যটন কেন্দ্রের রূপ লাভ করেছে-যার মধ্যে ঘাঘরবুড়ি ও কল্যানেশ্বরীর নাম সর্বাগ্রে উল্লিখিত। মানসিক কামনা-বাসনা পূর্ণ হওয়ার অভিলাষে বহু ভক্তের সমাগম লক্ষ করা যায় এই দুই পূণ্যভূমিতে।সাথে বিয়ের মতো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানও সুচারুভাবে সম্পন্ন হওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা প্রশংসনীয়। অন্যদিকে কল্যানেশ্বরীর মাইথন ড্যাম্পটি খুব জনপ্রিয় পিকনিক স্পট।
আসানসোল মানে রাতের বড়ো বাজারের ব্যস্ততার সাথে ফুটপাতের সংকীর্ণ গলির ঠাসা ভিড়। কোর্টের ভুল ঘড়ি,আপকার গার্ডেনের পুজো ও অষ্টমীতে আসানসোল মিশনে অঞ্জলি দেওয়ার ধুমে আমি আপনি সকলেই উচ্ছ্বাসী। শ্যামাপুজো উপলক্ষ্যে বার্নপুরের 36 ফুট কালীঠাকুরের মূর্তি আসানসোলের এক মাইলস্টোন বিশেষ। শীতের বড়োদিনকে উপলক্ষ্য করে খ্রিস্টমাসে সাজানো চার্চে সেই আলোর ঝলকানি শহরবাসীকে নস্ট্যালজিক করে তুলেছে। বছরের শেষে চৈত্র সংক্রান্তিকে উপলক্ষ্য করে চন্দ্রচূড়ের গাজন উৎসব মানুষের আনন্দকে এক অন্যমাত্রা দান করে। আসানসোল মানে ভালোবাসার শহর,ভ্রাতৃত্বের শহর,প্রাণখোলা আড্ডা আর চরম ব্যস্ততার সাথে নতুন গানের ব্যান্ড।।
আসানসোল সম্পর্কে আরো তথ্য পেতে নিয়মিত জুড়ে থাকুন আমাদের eFindout.Com ওয়েবসাইটে। ধন্যবাদ!