খুন, যুদ্ধ, মন-কষাকষি, শাস্তিসাজা – কি হয়নি! একদিকে এটি যেমন মানুষের ব্যথা বেদনার উপশম ঘটিয়েছে, অন্যদিকে মানুষকে পাশবিক আচরণেও উদ্বুদ্ধ করেছে। পপিচাষ ও আফিম-প্রস্তুতি সংক্রান্ত প্রাচীনতম নিদর্শনটি পাওয়া গেছে পাঁচহাজার খ্রীস্টপূর্বাব্দের একটি সুমেরীয় মাটির ফলকে। সুমেরীয় লিপিতে পপির ভাবলেখ (ভাবনির্দেশক রেখা) ছিল হালগিল’ (অর্থাৎ আনন্দদায়ক উদ্ভিদ) আসিরীয় চিকিৎসাফলক গুলিতে আফিমকে ‘আরৎ পা পা’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় যে প্রায় একই সময়ে ইউরােপেও পপিফুলের আফিম ব্যবহৃত হত। সুইজারল্যান্ডের হ্রদে পপিফুলের খােল পাওয়া গেছে। এই খােলগুলিকে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে এগুলি প্রাচীন প্রজাতির প্যাপাভার সেটিগেরামের খােল নয়, রীতিমত কৃষিজাত পপির খােল। অবশ্য এটি নির্ধারণ করা যায়নি যে সেই উদ্ভিদগুলি তেলের জন্যে না মাদক রসের জন্য চাষ করা হয়েছিল।
শিশুদের দাঁত ওঠার সময়ে যে সব রােগভােগ হয়, মিশরে তার চিকিৎসার জন্য সেই ২০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে আফিম ব্যবহৃত হত। মিশরীয়রা শিশুকে ঘুম পাড়ানাের জন্যেও এই মাদকটিকে কাজে লাগাত। রােমান লেখক প্ৰসপাস আলপিনাসের মতে মিশরীয়রা পাক্কা আফিমশাের ছিল আর এই বস্তুটির জন্য তারা পাগল হয়ে উঠত। এটি থেকে তারা ক্রেটিক মদ তৈরী করে পান করত। সেই পানীয়কে সুস্বাদু করার না গােলমরিচ আর কিছু সুগন্ধী যােগ করত। ওল্ড টেস্টামেন্টের কয়েকটি অংশ থেকে জানা যায় যে প্রাচীন হিব্রু জাতির মানুষেরাও আফিমের কথা জানত। এই পুরাতন গ্রন্থটিতে সম্ভবত ‘রােশ’ (অর্থ ‘মাথা’) বলতে পপির মাথাকে আর মেরােশ মানে পপিরসকে বুঝিয়েছে।
বিশ্বের প্রাচীনতম চিকিৎসাবিষয়ক নিদর্শন এবার্স প্যাপিরাসেও আফিমের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই দলিলটি নীল নদের পূর্বতীরে অবস্থিত লুক্সর নগরের একটি কবরখানা থেকে উদ্ধার করা হয়। এটি একটি মমির পায়ের কাছে সযত্নে রাখা ছিল। এটি আনুমানিকভাবে ১৫৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত হয়েছিল। এই দলিলটিকে এবার্স প্যাপিরাস’ বলা হয় কারণ অধ্যাপক এবার্স ১৮৭২ সালে এটিকে এক বিক্রয়মেলায় আবিষ্কার করেন। এই প্যাপিরাসটিতে ক্রন্দনরত শিশুকে শান্ত করার ঔষধ হিসাবে, আফিম ও আরেকটি রাসায়নিকের মিশ্রণের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই কিছুদিন আগেও মিশর, ভারত এমনকি ইউরােপেও শিশুকে শান্ত করার জন্য আফিম প্রয়ােগ করা হত। মায়েরা তাদের স্তনবৃন্তে পপিরস লাগিয়ে, ছিচকাঁদুনে শিশুকে ‘মাদক দুধ খাইয়ে ঠাণ্ডা করতেন। একটি প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে জানা যায়।
সম্ভবত এককালে লােকে আফিম আর গাঁজাকে গুলিয়ে ফেলত। খুশ খুশ (পপিবীজ) শব্দটিকে কখনও কখনও খাস খাস’ বলা হয় আর সম্ভবত এই উচ্চারণের থেকে উৎপত্তি হয়েছে হাশিস শব্দটির গ্রীক মহাকবি হােমার (খ্রীস্টপূর্ব নবম শতাব্দী) আফিমের কথা জানতেন এবং তার ইলিয়াড ও ওডিসি গ্রন্থে এর উল্লেখ পাওয়া গেছে। হােমার যে সময় বেঁচেছিলেন সে সময়ে নেপেনথিস নামের একটি অদ্ভুত মাদকের ব্যবহার ছিল। এটিকে ‘বিস্মৃতির মাদক’ও বলা হত। গ্রীসে এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। নেপেনথিসের একটি প্রধান উপাদান ছিল আফিম ! ট্রোজান যুদ্ধের এক প্রধান নায়ক টেলিমেকাস, স্পার্টায় মেলেনাসের সাথে সাক্ষাতের জন্য গিয়েছিলেন। সেই মুহুর্তে তিনি তার পিতা ওডিসিয়াসের জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন, টেলিমেকাসের এই দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য, মেলেনাসের স্ত্রী হেলেন তাকে নেপেনথিস খেতে দিয়েছিলেন—যাতে তিনি চিন্তামুক্ত হতে পারেন।
মনে হয় গ্রীক যােদ্ধারা যুদ্ধের আগে নিয়মিতভাবে নেপেনথিস খেতেন যাতে বিপদ-আপদের যাবতীয় ভয় মন থেকে দূর হয়ে যায়। সম্ভবত হেলেন নেপেনথিসের ক্কাথ এর পরেও বহু বার তৈরী করেছিলেন। এই দ্রবণ প্রস্তুতির উপায়টি তিনি মিশরীয় রাণী পলিড়ামনার কাছে শিখেছিলেন, ঘটনাটি খুবই বিশ্বাসযােগ্য কারণ সে যুগে মিশরে প্রচুর পরিমাণে পপি ফুল ফুটত। বস্তুতপক্ষে সিসিয়ন নামের একটি মিশরীয় শহরে এমন ব্যাপক হারে পপির চাষ হত যে শহরটির নাম হয়েছিল “মেকন” অর্থাৎ পপিফুলের শহর। গ্রীক ভাষায় মেকন শব্দটির অর্থ পপি। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় যে এই মেকন শব্দটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের শব্দ মেকানিয়নের সাথে সাদৃশ্য বজায় রাখে। সদ্যোজাত শিশুর প্রথম মলকে মেকোর্নিয়ন বলে। এই নামকরণের কারণ শিশুর মলের সাথে পপি-নিঃসৃত গাঢ় রসের অদ্ভুত মিল আছে। মেকোন শব্দটি মেকানিক অ্যাসিডেও পাওয়া যায়। কাঁচা অফিমে প্রায় শতকরা ৭ ভাগ এই অ্যাসিড থাকে ।
প্রাচীন ইটালির ভুট্টা বা কর্ণ-শস্যের দেবীর নাম ছিল সেরেস (সেরিয়াল কথাটি এই নামানুসারেই হয়েছে)। এই দেবী তার যন্ত্রণা উপশমের জন্য আফিম নিতেন, তাই তার মূর্তিতে হাতে পপিফুলের মাথা দেখতে পাওয়া যায়। বহু প্রাচীন শিল্পকলায় পপিকে প্রাচীন ঘুমের প্রতীক হিসাবে ধরা হয়। এটিকে ঘুমের দেবতা হিপনােসের মূর্তিতেও দেখা যায়, যেখানে শ্মশ্রুশােভিত একটি লােককে, একজন ঘুমন্ত মানুষের চোখের পাতায়, একটি পশু-শৃঙ্গ নির্মিত পাত্র থেকে পপি রস ঢালতে দেখা যায়। স্ত্রীবােনিয়স লার্জাস (খ্রিস্টাব্দ ৪০) পপি প্রস্তুতির একটি পদ্ধতির উল্লেখ করেছেন এবং এও বলেছেন যে উৎকৃষ্ট শ্রেণীর এই মাদক দ্রব্য, পপির খােল থেকেই পাওয়া সম্ভব, গাছটির অন্য কোন অংশ থেকে নয়।
রোমক মুদ্রায় পপির চিহ্ন খােদিত ছিল। ইহুদি ইতিহাসে, জন হিরকানাসের ব্রোঞ্জ মুদ্রায় পপির চিহ্ন পাওয়া যায়। হিরকানাস ছিলেন একাধারে রাজপুত্র ও মাকাবিশ জাতির প্রধান পুরােহিত (১৩৫-১০৬ খ্রীস্টপুর্ব)। আফিম-নিঃসৃত পপির মূল উৎসস্থল সম্ভবত এশিয়া মাইনর (আধুনিক তুরস্ক)। এখান থেকেই অন্যান্য অঞ্চলে আফিম ছড়িয়ে পড়েছিল। হিব্রুতে একে ওফিঅন’ বলত আর আরবরা বলত, আফ-ইউন! দুটি নামই ‘আফিম’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। চীনা ভাষার ও-ফিউউং এই আরবী শব্দেরই অপভ্রংশ।
গ্রীক চিকিৎসক হিপােক্রেটাসকে (৪৬০-৩৭৭ খ্রীস্টপুর্ব) চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক বলা হয়। সম্ভবত তিনিও পপি রসের কথা জানতেন কারণ তিনি মেকন নামের একটি রেচন-প্রতিরােধী রাসায়নিকের উল্লেখ করেছেন যা মাদক গুণসম্পন্নও বটে। তবে পপিরসের প্রথম প্রামাণিক উল্লেখ করেন গ্রীক উদ্ভিদবিজ্ঞানী থ্রিওফ্রাসটাস (৩৭২-২৮৭ খ্রীস্টপুর্ব) মেকানিয়ম নামে।
১৬৯-২৪৭ খ্রিস্টাব্দ কালটিতে রােমের সবচেয়ে নামজাদা চিকিৎসকের নাম ছিল গ্যালেন। গ্যালেন আফিমের গুণাগুণ সম্বন্ধে জোরগলায় প্রচার করতে থাকেন আর তাই দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে আফিম অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই মাদকদ্রব্যটি তখন রােমের সাধারণ দোকানদার ও হাতুড়েরাও খােলাখুলি বিক্রি করতেন। অবশ্য এটি সম্ভব হয় কারণ তৎকালীন রােমক সম্রাট সেবেরাস এই মাদক দ্রব্যের ব্যবহারের উপর যাবতীয় বিধিনিষেধ তুলে দেন।
আরব মুলুকের চিকিৎসকরা ব্যাপকভাবে আফিম ব্যবহার করতেন। সবার আগে উল্লেখ করতে হয় আভিসেন্নার (৯৮০–১০৩৭ খ্রীস্টাব্দ) কথা। আভিসেন্না আন্ত্রিক ও চোখের রােগে আফিম প্রয়ােগ করার পরামর্শ দিতেন। কথিত আছে, তিনি নাকি অতিরিক্ত পরিমাণে আফিম সেবন করে মৃত্যুবরণ করেন। প্রায় এই সময়েই আরব সদাগররা প্রাচ্য দেশে আফিমের প্রচলন করেন। কোরানে মদ্যপান সম্বন্ধে নিষেধাজ্ঞা থাকায় মুসলমানেরা খুব স্বাভাবিকভাবে আফিমের নেশার প্রতি আকৃষ্ট হত। মােগল বাদশাহ বাবর আর হুমায়ুন দুজনেই ঘাের আফিমধাের ছিলেন।
আরব ব্যবসায়ীরাই চীন ও প্রাচ্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নবম শতাব্দী নাগাদ, আফিমের প্রচলন করেন। বহু বিদেশী পর্যটকের ভ্রমণ বৃত্তান্তে আফিমের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৫১১ সালে ভারত ভ্রমণ কালে বার্বসা, মালাবার উপকুলে আফিমের প্রচলন দেখেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল যে এই মাদকটি একান্তই ভারতীয় উৎপাদন। ১৫৪৬ সালে ফরাসী প্রকৃতিবিদ বেলোঁ, এশিয়া মাইনর ও মিশর ভ্রমন করার সময় লক্ষ করেছিলেন তুর্কিরা কি পরিমাণে আফিমের প্রতি আসক্ত। এদের আসক্তি এতটাই তীব্র ছিল যে তারা শেষ কপর্দকটি ব্যয় করেও আফিম কিনে চলতো।
আফিম পাওয়া যায় পপি গাছ থেকে। উদ্ভিদবিদের কাছে পপিগাছ প্যাপাভার সােমনিফেরাম নামে পরিচিত। এটি একটি দ্বিবীজপত্রী (এর বীজের দুটি পত্রের মত ভাগ থাকে) উদ্ভিদ। এটি প্যাপাভেরাসি গােত্রের প্রাণী। এই গােত্রটি ক্রুসিফেরি গােত্রের নিকটসম্বন্ধী। বাঁধাকপি কুসিফেরি গোত্রের সদস্য। গ্রীক শব্দ প্যাপাভারের অর্থ পপি। সােমনিফেরাম একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ ‘ঘুম এনে দিই। যেহেতু আফিম ঘুমকে ডেকে আনে, এই নামটি খুবই উপযুক্ত। পপিগাছের উৎপত্তি এবং নেশাখােরদের উপর এর প্রভাব সম্বন্ধে একটা দারুণ উপকথা প্রচলিত আছে। বহু যুগ আগে গঙ্গার ধারে এক ঋষি থাকতেন। তার সাথে একটা ইদুর থাকত। ইদুরটা সর্বদাই বেড়ালের ভয়ে ভীত হয়ে থাকত।
একদিন সে ঋষিকে অনুরােধ করল যাতে তিনি সেটিকে বেড়ালে রূপান্তরিত করেন। তার কথামত ঋষি তার যােগবলে ইঁদুরটিকে বেড়াল বানিয়ে দিলেন। এবার কিন্তু তাকে কুকুরেরা বিরক্ত করতে লাগল। সে ঋষিকে কুকুর হওয়ার আর্জি জানাল। ঋষি এবারাে তার মনস্কামনা পূর্ণ করলেন। সে এতেও সন্তুষ্ট হল না । এরপর ঋষি তাকে ক্রমে ক্রমে বাঁদর, শুয়াের, হাতি ও শেষমেশ এক সুন্দরী নারী করে দিলেন। পােস্তমণি নাম্নী এই সুন্দরী এক রাজার পাণিগ্রহণ করল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে একদিন একটি কুয়ােয় পড়ে গিয়ে মারা গেল। শােকবিধ্বস্ত রাজা তার স্ত্রীর মৃতদেহ নিয়ে ঋষির কাছে ছুটে গেলেন আর কাতর হয়ে তার প্রাণ ভিক্ষা করলেন। ঋষি রাজাকে কথা দিলেন যে রাণী পােস্তামণিকে তিনি অমর করে দেবেন। এই বলে তিনি পােস্তামণির মৃতদেহটি পােস্ত বা পপিগাছে রূপান্তরিত করলেন।
ঋষি বললেন, “এই গাছটি থেকে তৈরি হবে আফিম – যা মানুষ লােভে পরে খাবে। যে আফিম খাবে তাকেই পােস্তমণি যে ধাপগুলাে অতিক্রম করে রাণী হয়েছিল, সেই ধাপগুলাে পেরিয়ে আসতে হবে। সে ইদুরের মত ক্ষতিকর, বেড়ালের মত দুধের ভক্ত, কুকুরের মত কুঁদুলে, বানরের মত নােংরা, শুয়ােরের মত জংলি, হাতির মত শক্তিশালী আর রাণীর মত প্রাণােচ্ছল হবে।”