ঘাগরবুড়ির চণ্ডী মন্দির যে শুধু অতি প্রাচীন তাই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক অলৌকিক উপাখ্যান এবং কিংবদন্তি। সে আজ প্রায় ৫০০ বছর আগেকার কথা। আজকের আসানসোল মহানগর তখন ধূ ধূ করা মাঠ এবং আসান গাছের জঙ্গল (আসান হচ্ছে এক ধরনের বৃহৎ উদ্ভিদ, যার ছাল ফুটো করলে বেরোয় প্রচুর সুমিষ্ট পেয় জল আর সল হচ্ছে রাঢ় বাংলার ডাঙ্গাল জমি। তবে দুঃখের বিষয়, এখন আর আসানসোলে আসান গাছ দেখা যায় না, যদিও তামিলনাড়ু ও দক্ষিণ ভারতে পাওয়া যায়।)
জনমানবহীন প্রান্তরে এক-আধটি বাড়ি, দু-তিনটি বাড়ি নিয়ে একেকটি ক্ষুদ্র গ্রাম। এই ছন্নছাড়া গ্রামগুলোতে যজমানি করতেন এক গরীব ব্রাহ্মণ – কাঙালীচরণ চক্রবর্তী। প্রতিদিন তখনকার নুনিয়া নদী(আজকের শীর্ণকায়, খাল সদৃশ, নুনিয়া নয়) পেরিয়ে ওধারের গ্রামগুলিতে যেতেন পুজো অর্চনা করতে, আবার পদব্রজে নদী পেরিয়ে ফিরে আসতেন নিজ বাটিতে। এইভাবেই বহুকষ্টে দিন গুজরান করতেন। কিন্তু তবুও তো সংসার চলে না। এরকমই এক শীতের দিনে – দিনটি ছিল ১লা মাঘ, যজমানের ঘরে পুজো করে সেদিন কিছুই পাওয়া যায়নি। নুনিয়া নদী পেরিয়ে এসে ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত কাঙালীচরণ এক গাছতলার শীতল ছায়ার নীচে শুয়ে পড়লেন। কাতর ভাবে ডাকতে লাগলেন মা চণ্ডীকে।
কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ কীসের আওয়াজে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন। এই জনহীন প্রান্তরে কে যেন লাঠি ঠুক ঠুক করে আসছে না? বুঝতেই পারেননি যে এত বেলা হয়ে গেছে। যখন জেগে ছিলেন তখন সূর্যদেব মাথার ওপরে ছিলেন, আর এখন প্রায় অস্তাচলে। কিন্তু বাঁশের লাঠির ঠুক ঠুক ছাড়া তো আর কোনো শব্দও শোনা যাচ্ছে না। নুনিয়া নদীর গর্জনও থেমে গেল কী করে, আশ্চর্য!
একি! দিনের আলো তো এখনও আছে, অথচ কিছুটা জায়গা একদম অন্ধকার কেন? তবুও তো সেই অন্ধকারের মধ্যে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে – এক ঘাগরা পরিহিত বুড়ি ঠুক ঠুক করতে করতে বাঁশের লাঠি নিয়ে উনার দিকেই তো এগিয়ে আসছেন। সেই বুড়ি কিছু না বলে কাঙালীচরণের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাঙালীচরণের চোখ যেন ঝলসে গেল, সারা শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ ঝলক বয়ে গেল। ব্যস, আর কিছু মনে নেই। ঘুমের অতলে ডুবে গেলেন। ঘুমের মধ্যেই দেখলেন সেই বুড়িকে আবার। পরিষ্কার শুনতে পেলেন – ‘তোর আর উঞ্চবৃত্তির দরকার নেই, তোর কোলেই দেখবি তিনটি ছোট পাথরের ঢিবি রেখে এসেছি। মাঝখানে আমি – মা ঘাগরবুড়ি, আমার বাঁয়ে মা অন্নপূর্ণা, ডাইনে পঞ্চানন মহাদেব। এইখানেই মন্দির প্রতিষ্ঠা কর, আর কোথাও যেতে হবে না।’
মা ঘাগরবুড়ির আদেশে মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ১৬২০ সালে। এই পাথরের ঢিবিগুলিকেই ফুল এবং রুপোর গয়নায় সাজানো হয়। আর সেই ১৬২০ সালের ১লা মাঘকে স্মরণ করে প্রতি বছর মন্দিরের সামনের মাঠে বসে ঘাগরবুড়ি চণ্ডীমাতার মেলা।
আসানসোল মহকুমা যেমন কয়লা ও ইস্পাত শিল্পের জন্য বিখ্যাত তেমনি বিভিন্ন জাগ্রত দেব-দেবীর আর্শীবাদ পুষ্ট ও মহিমা মন্ডিত। আসানসোল শহরের উত্তরে ক্লেদবাহী শীর্ণকায় নুনীয়া নদীর তীরে অধিষ্টিতা রাঢ় বাংলার জাগ্রত দেবী মা শ্রীশ্রী ঘাঘর বুড়ি।
কে এই ঘাঘর বুড়ি? কি ভাবে এখানে প্রতিষ্ঠিতা হলেন? ইতিহাস বলছে কাশিপুর মহারাজার রাজ্য সীমানা ছিল আসানসোল পর্য়ন্ত। জমি জমার পুরানো রেকর্ড থেকে (সি এস) দেখা যায় তদনীন্তন কাশীপুর মহারাজের নাম।
প্রমান্য তথ্য থেকে জানা যায় বহু প্রাচীন কাল থেকে অনাচ্ছাদিত মন্দিরে, গাছ তলায় পুজা হয়ে আসছে মা ঘাঘর বুড়ির। (বর্তামানে নির্মিত মনোরম মন্দির)। ইনি দেবী শ্রীশ্রী চন্ডী। কোন মূর্তি নেই। শুধু তিনটি শীলা। ঘাঘর শব্দের অর্থ হল – ঝাঁজ বাদ্য ও ঘুঙুর। পুরানে দেব-দেবীর বিভিন্ন পুজা পদ্ধতির উল্লেখ আছে- তার মধ্যে নৃত্য গীত-বাদ্য সহকারে বহু দেবীর পূজার প্রচলন ছিল।
মায়ের মন্দির সংলগ্ন এলাকাটি আদিবাসী অধ্যুষিত। অতীতে যে মায়ের পূজা নৃত্য-গীত-বাদ্য সহকারে হত সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ঘাঘর শব্দের আরেকটি অর্থ হল নদী। নুনীয়া নদীর দক্ষিন তীরে মায়ের মন্দির- এমনও হতে পারে- যে এই জন্যই দেবী চন্ডীর এখানে নাম হয়েছিল ”ঘাঘর বুড়ি”।