কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিধান রায় আজ্ঞাবহ ভৃত্য ছিলেন না। সত্যি বিস্ময়, বিধান রায় যদি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী না হতেন! কোনও সন্দেহ নেই ইতিহাস অন্য পথে হাঁটত। বিধানবাবু এক জন বহুমুখী সক্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। ভারী শিল্প এবং সমস্ত নতুন নতুন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর, সবই তো ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর নিজের হাতে করা। পড়ুন ওনার কাজের বহু অজানা তথ্য।
★★ পাটনার বাঁকিপুর থেকে যখন খালি পায়ে কলকাতা আসেন, পকেটে ছিলো তার মাত্র পাঁচ টাকা পঁচিশ পয়সা। একেবারে বিনা চিকিৎসায় শৈশবে তার মাতৃবিয়োগ হয়। প্রত্যন্ত অজপাড়াগাঁয়ের দরিদ্র অঞ্চলে মৃত মায়ের শ্রাদ্ধ করার জন্যও রায় পরিবারের আর্থিক সংগতি ছিলনা।
★★ ভাইবোন মানে খুড়তুতো জ্যাঠতুতো মিলিয়ে বিধানবাবুরা ছিলেন ১৮ জন।বিধান বাবুর বাবা ছিলেন একজন সাধারণ সরকারি কর্মচারী।ঐ সামান্য বেতনে বাড়ির সবার পেট ভরানোই ছিল সবচেয়ে চিন্তার বিষয়। সরকারি কাজে যাতায়াতের জন্য ওনার বাবার একটা ঘোড়ার গাড়ি ছিল। ঘোড়ার খাবার হিসেবে বিট-গাজর সরকার থেকে যা আসত খিদের জ্বালায় ভাই বোনেরা কাঁচাই সেই বিট-গাজর খেয়ে নিতেন। আর ঘোড়াকে খাওয়াতেন ঘাস।
★★ ডাক্তার হবার খুব যে ইচ্ছে ছিল তেমনটা মোটেও বলা যায় না। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ফর্মের জন্য আবেদন করেছিলেন। ডাক্তারির ফর্মটা আগে আসায় ওইটাই আবেদন করে পূরণ করে পাঠিয়ে দিলেন। শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফর্ম যখন এল ততক্ষণে ডাক্তারিতে ভর্তি হয়ে গেছেন।
★★ থাকতেন কলেজ স্ট্রিট ওয়াই এম সি এ-তে। টাকা পয়সার টানাটানি ভীষণ, মাস্টারমশায়রা ছাত্রকে অবসর সময়ে ধনী রোগীদের বাড়িতে মেল নার্স হবার সুযোগ করে দিতেন। রোগীর বাড়িতে বারো ঘণ্টার ডিউটিতে পারিশ্রমিক পেতেন আট টাকা।
★★ ডাক্তার হিসেবে প্র্যাকটিস এর শুরুতে রোজগার তেমন হচ্ছেনা দেখে পার্ট টাইম ট্যাক্সি চালাতেন।
★★ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এমবি পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন।
★★ এই একই তিনিই মাত্র ১২০০ টাকা সম্বল করে বিলেত গেলেন দু’বছরে মেডিসিন ও সার্জারির চূড়ান্ত সম্মান এম আর সি পি এবং এফ আর সি এস শেষ করবেন বলে। বিলেতের সেন্ট বারথোলমিউ কলেজে ডাক্তারি পড়ার জন্য আবেদন করলেন। ওখানকার অধ্যক্ষ সাফ বলে দিলেন, “ এ দেশের দারুণ মেধাবি ছাত্ররাও দুটি কোর্স একসঙ্গে শেষ করতে পারেনা।তুমি ভারত থেকে এসে সেটা করে ফেলবে?’’ প্রত্যাখান হয়ে গেল বিধানবাবুর আবেদন। দমলেন না। আবার করলেন আবেদন। এবারও ফল একই- প্রত্যাখান।আবার করলেন-আবারও প্রত্যাখান। এইভাবে টানা ৩০ বার আবেদন করার পর অবশেষে গ্রাহ্য হল আবেদন। দু’ বছরে মেডিসিন ও সার্জারির চূড়ান্ত সম্মান এম আর সি পি এবং এফ আর সি এস শেষ করলেন।এ এক অবিশ্বাস্য কৃতিত্ব।
★★ সবে ডাক্তারি করা শুরু করেছেন, নামডাকও হয়েছে, সেই সময় প্রেমে পরলেন একজন যুবতীর যার বাবা আবার বিরাট নামকরা ডাক্তার। সেই নামকরা ডাক্তারের কাছে গেলেন তার মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে একদিন ।বিয়ের প্রস্তাব শুনে মেয়ের বাবা সদ্য ডাক্তার বিধান কে জিজ্ঞাসা করলেন “ তোমার মাসিক আয় কত বাবা?” সবে ডাক্তারি করা শুরু করেছেন তখন। ফলে রোজগারও তেমন নয়। রোজগার শুনে মেয়ের বাবা তরুণ বিধানকে বললেন-তোমার যা মাইনে, আমার মেয়ের হাতখরচ তার চেয়ে বেশি।এই রোজগারে মেয়ের সারা বছরের খরচা সামাল দেবে কিভাবে!! সেই দিন তরুণ বিধানের কাছে কোন উত্তর ছিলনা। সেই যে আঘাত পেলেন, এরপর বাকি জীবনটা চিরকুমারই থেকে গেলেন। ১৯৪৮-এ যখন ডাক্তারি পেশা ছেড়ে মুখ্যমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করছেন তখন ডাক্তারি থেকে ওনার মাসে আয় ছিল ৪২০০০ টাকা। সেই সময় ৪২০০০ টাকা মানে আজকের বাজারে কত সেটা বোঝাতে একটা ছোট্ট হিসেব দেওয়া যাক। ১৯৪৭-এ ১০ গ্রাম সোনার দাম ছিল- ৮৮.৬২ টাকা যা বেড়ে এখন প্রায় ২৯০০০ টাকা। অর্থাৎ এই ৭০ বছরে সোনার দাম বেড়েছে প্রায় ৩২৭ গুণ।সেই হিসেবে ওনার সেই সময়ের ৪২০০০ টাকা প্রতি মাসে, আজকের হিসেবে দাঁড়ায় ১,৩৭,৩৪০০০ টাকা। মেয়ের বাবা ছিলেন, স্বনামধন্য চিকিৎসক স্যর নীলরতন সরকার। সেদিনের তরুণ প্রেমিক মুখ্যমন্ত্রি হয়ে বাসস্থানের জন্য গড়ে তুললেন কল্যাণী উপনগরী, লেক টাউন, লবণহ্রদ নগর । স্যর নীলরতনের মেয়ের নাম ছিল কল্যাণী।
★★ চিত্তরঞ্জন দাশের মহাপ্রয়াণের পর দেশবন্ধুর একটা ছবি বিক্রি করে বিধানচন্দ্র কিছু টাকা তোলবার পরিকল্পনা করেন। এ বিষয়ে পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য একটি চিঠিতে লেখেন, “চিত্তরঞ্জনের একটা ছবি নিয়ে বিধানচন্দ্র রায় কবির কাছে গিয়ে বললেন এর উপর একটা কবিতা লিখে দিন।“ডাক্তার, এ তো প্রেসক্রিপশন করা নয়। কাগজ ধরলে আর চটপট করে লেখা হয়ে গেল।”
উত্তর: “বেশ অপেক্ষা করছি।”
কিন্তু বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ছবির উপর সেই অপূর্ব কবিতাটি লেখা হল —“এসেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”
★★ বিধানচন্দ্র যখন কলকাতার মেয়র, তখন (১৯৩১) কবিগুরুর সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয় সেখানে কবিগুরুর উত্তর আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।“এই পুরসভা আমার জন্মনগরীকে আরামে, আরোগ্যে, আত্মসম্মানে চরিতার্থ করুক, ইহারা প্রবর্তনায় চিত্রে, স্থাপত্যে, গীতিকলায়, শিল্পে এখানকার লোকালয় নন্দিত হউক, সর্বপ্রকার মলিনতার সঙ্গে সঙ্গে অশিক্ষার কলঙ্ক এই নগরী স্খালন করিয়া দিক পুরবাসীর দেহে শক্তি আসুক, গৃহে অন্ন, মনে উদ্যম, পৌরকল্যাণ সাধনে আনন্দিত উৎসাহ। ভ্রাতৃবিরোধের বিষাক্ত আত্মহিংসার পাপ ইহাকে কলুষিত না করুক শুভবুদ্ধি দ্বারা এখানকার সকল জাতি, সকল ধর্মসম্প্রদায় সম্মিলিত হইয়া এই নগরীর চরিত্রকে অমলিন ও শান্তিকে অবিচলিত করিয়া রাখুক, এই কামনা করি।”
★★ শোনা যায়, দিল্লির এক পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়ে গভর্নর জেনারেল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন বিধানচন্দ্র সম্বন্ধে এতই মুগ্ধ হন যে তিনি জওহরলালকে বলেন, লাট সাহেবের পদে না বসিয়ে এঁকে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব দিন।
★★ বিধানচন্দ্র রায়ের আরেকজন প্রিয় রোগী ছিলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দুজনার মধ্যে ছিল এক মধুর সম্পর্ক। চিত্তরঞ্জন দাশের মহাপ্রয়াণের পর দেশবন্ধুর একটা ছবি বিক্রি করে তিনি কিছু টাকা তোলবার পরিকল্পনা করেন। ছুটে গেলেন কবিগুরুর কাছে। গিয়ে বললেন- ছবিতে দুটো লাইন লিখে দিতে। কবি বললেন, “ডাক্তার, এ তো প্রেসক্রিপশন করা নয়। কাগজ ধরলে আর চটপট করে লেখা হয়ে গেল।”
কিন্তু ডাক্তার নাছোড়বান্দা- সকাল, দুপর, সন্ধ্যা বয়ে যায়। কবি আর কিছুই লিখেন না। বারবার দেশবন্ধুর ছবির দিকে চেয়ে থাকেন। লিখতে গিয়ে আর লিখতে পারেন না। অবশেষে লিখলেন- সেই বিখ্যাত অপূর্ব লাইন দুটি। যা আজো মানুষের মুখে মুখে ফিরে।
“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”
★★ ১৯১২ সাল থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত NRS হাসপাতালে অ্যানাটমি (শরীরবিদ্যা) বিভাগে শিক্ষকতা করেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। তাঁর ব্যবহৃত একাধিক জিনিস ছিল হাসপাতালে। এখন আর সেসব নেই। তবে তাঁর ব্যবহৃত চেয়ারটির খোঁজ পাওয়া গেছে।তাই এটিকে নিয়ে হাসপাতালে তৈরি হচ্ছে মিউজ়িয়াম। শুধু তাই নয়, এই প্রথম রাজ্যের কোনও হাসপাতাল মিউজ়িয়াম তৈরি করতে চলেছে। যেখানে কাঁচের ঘরের ভেতর রাখা হবে চেয়ারটি। এছাড়া তাঁর নামে একটি লেকচার হলও তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে NRS হাসপাতাল।
★★ তিনি সাংবাদিকদের একটু এড়িয়েই চলতেন যতটা সম্ভব। কিন্তু একদিন আর পারলেননা।সরাসরি প্রশ্নের মুখে পড়ে গেলেন। তুলে দেওয়া হল সরাসরি
:আমরা আপনার কী ক্ষতি করলাম?! না পারি কাছে ঘেঁষতে, না পারি সংবাদ নিতে?!
: আপনাদের নিয়ে ভয়ের আমার অন্ত নেই। আপনারা দোধারি তলোয়ার।
: এই তলোয়ারে আপনার কী ধরনের ভয়?!
: জবাব দেওয়ার ভয়।
: সে আবার ভয় কী! আপনার জবাব আপনি দেবেন, তাতে আবার ভয় কী! সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলে দিলেই হলো!
: না, হলো না। আপনাদের প্রশ্নের ধরন-ধারণ বড় উদ্ভট থাকে। একটা উদাহরণ নিন, তাহলেই আমার ভয়ের কারণ বুঝতে পারবেন। আপনারা এমনভাবে প্রশ্ন করেন, ‘হ্যা’ বলাও বিপদ, ‘না’ বলাও। বলা যায়, এটির চেয়ে অন্যটি বড় বিপদ।
: যেমন?
: যেমন, এই ধরুন- আপনি কি স্ত্রী প্রহার বন্ধ করেছেন? এর জবাবে আমি যদি ‘হ্যা; বলি, তার অর্থ হবে-আমি আগে পেটাতাম, এখন বন্ধ করেছি। এটি আমার ব্যাপারে কোনো ভালো খবর নয়। যদি আপনাদের প্রশ্নের জবাবে আমি ‘না’ বলি, বুঝতে হবে আমি এখনও স্ত্রী প্রহারের মতো মন্দ কাজ অব্যাহত রেখেছি। যা এমন এক সংবাদ, একজন মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাপারে কোনোদিনই কানে তোলার নয়। এবার আপনারাই বলুন, আমি কী করব! আপনাদের তাড়ানোর কথা আমি বলব না, এড়ানো-সরানো ছাড়া আমার কি আর উপায় আছে। বয়সের এই ধাপে প্রহারের জন্য পিঠবিছানো কি আমার পক্ষে সম্ভব! আপনারাই ভেবে বলুন।” এমন বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা একমাত্র বোধহয় ওনার পক্ষেই সম্ভব ছিল।
★★ সল্টলেকে জমির দাম কত ? কত হতে পারে, অনুমান করুন। তাহলে, গোটা সল্টলেকের দাম কত ? মাথা ঘুরে যাওয়ারই কথা। অথচ, গোটা সল্টলেকের দাম ধার্য হয়েছিল মাত্র এক টাকা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। আর এই কান্ডটাই করে দেখিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়।স্বাধীনতার পর তখন পিলপিল করে ওপার বাংলা থেকে আসছে উদ্বাস্তুরা। ছড়িয়ে গেল বাংলার নানা জায়গায়। এত এত মানুষ থাকবে কোথায় ? খাবে কী ? কর্মসংস্থানই বা হবে কোথায় ? সমস্যা বেশ গুরুতর। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সামনে বড় এক চ্যালেঞ্জ। একদিন ডেকে পাঠালেন প্রফুল্ল সেনকে।মন্ত্রীসভার কাজ চালানোর ব্যাপারে প্রফুল্লবাবুর উপর অনেকটাই নির্ভর করতেন। প্রফুল্লবাবুকে নিজের ঘরে ডেকে বললেন, পূর্ব কলকাতায় অনেক জলা জমি আছে। অনেক ভেড়ি আছে। সেগুলি বুজিয়ে ফেলতে হবে। এবং এই কাজটা তোমাকেই করতে হবে। শুনেই মাথায় হাত প্রফুল্ল সেনের। তিনি বললেন, ‘সেটা কী করে সম্ভব ? পুরো জায়গাটাই তো আমাদের হেমদার।’ হেমদা মানে, হেমচন্দ্র নস্কর, বিধান রায়ের ক্যাবিনেটে তিনিও একজন মন্ত্রী। বয়সে বিধানবাবুর থেকেও বড়। তাঁর জায়গা নিয়ে নেওয়া হবে! বিধানচন্দ্র বললেন, ‘যেভাবে হোক হেমদাকে বুঝিয়ে রাজি করাও।’প্রফুল্ল সেন পড়লেন মহা সমস্যায়। খোঁজ নিলেন সেচমন্ত্রী হেমচন্দ্র নস্করের। তখনও তিনি মহাকরণে ঢোকেননি। আধঘণ্টা পর পর ফোন হেম নস্করের ঘরে। এবার হেম নস্কর বললেন, কী ব্যাপার বলো তো। তোমরা তো আমাকে মন্ত্রী বলে মনেই করো না। আমাকে কোনও গুরুত্বই দাও না। আজ হঠাৎ এতবার খোঁজ কেন ? ঠিক আছে, তোমার ঘরে যাচ্ছি।’ প্রফুল্ল সেন বললেন, ‘আপনাকে আসতে হবে না, আমি আপনার ঘরে আসছি। ডাক্তার রায়ের আপনাকে দরকার।’ হেম নস্করকে একরকম পাকড়াও করেই নিয়ে গেলেন বিধান রায়ের কাছে। হেম নস্কর ভাবলেন অন্য কথা। বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি। মাছ লাগবে তো! ঠিক আছে, আপনাকে বড় মাছ পাঠিয়ে দেব। আর প্রফুল্ল, তমিও তো মাছ খেতে ভালবাসো। তোমাকেও মাছ পাঠিয়ে দেব।’ তখন বিধান রায় বললেন, ‘না না, মাছের কথা বলছি না। প্রফুল্ল, হেমদাকে বুঝিয়ে দাও আমরা কী করতে চাইছি।’প্রফুল্লবাবু আমতা আমতা করে বললেন, ‘হেমদা, আমরা পূর্ব কলকাতায় একটা নতুন উপনগরী করতে চাইছি। তার জন্য আপনার ওই ভেঁড়িগুলো বুজিয়ে ফেলতে চাই।’ শুনেই আঁতকে উঠলেন হেম নস্কর। ওগুলো দিয়ে দিলে আমি খাব কী ?’ বিধানবাবুও ছাড়ার পাত্র নন। তিনি বললেন, ‘আপনার অনেক টাকা আছে। ওগুলো না থাকলেও আপনার দিব্যি চলে যাবে। সরকারের হাতে টাকা নেই, তাই আপনার যা প্রাপ্য, সেই দাম দিতে পারব না। তবে একেবারে বিনামূল্যে নেব না। এক টাকা দেব।’পরিকল্পনা সাজানোই ছিল। ঘরে ঢুকে পড়লেন চিফ সেক্রেটারি। হাতে নকশা। আর জমি হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। ওই ঘরে বসিয়েই সই করিয়ে নেওয়া হল হেম নস্করকে। বেচারা মন্ত্রী! ঠিকমতো বুঝে ওঠার আগেই বিধানবাবুর কথায় সই করে ফেলতে হল।আগে থেকেই সল্টলেকের নকশা তৈরি করে রেখেছিলেন বিধান রায়। ফলে, কাজ শুরু হতে সময় লাগল না। দ্রুত শুরু হয়ে গেল সল্টলেক তৈরির কাজ। পুরো কাজটা বিধানবাবু দেখে যেতে পারেননি। আজকে আমরা যে সল্টলেক দেখছি, তার প্রায় পুরোটাই ছিল বিধান রায়ের পরিকল্পনা ও দূরদৃষ্টির ফসল।
★★ দুর্গাপুর ইস্পাতনগরী , চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা। বাসস্থানের জন্য তৈরি হল কল্যাণী উপনগরী, লেক টাউন, লবণহ্রদ নগর। দুদ্ধ সরবরাহের জন্য গড়ে তুললেন হরিণঘাটা দুগ্ধপ্রকল্প। শিক্ষিত বেকারদের বিপুল পরিমাণে কর্মনিয়োগের জন্য সৃষ্টি করলেন কলকাতা রাষ্ট্রীয় সংস্থা।
★★ তিনি ১৯৪৩-৪৪ খ্রীঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছায় গড়ে উঠল রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ, পুরুলিয়া , রহড়া, নরেন্দ্রপুরে প্রাচীন ভারতীয় আদর্শে আশ্রমিক পরিবেশে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়।
★★ বজবজে অথবা রাজ্যের কোনও উপযুক্ত স্থানে তেল শোধনাগার করতে চেয়েছিলেন তিনি। এই নিয়ে অসম এবং বিহার নিজেদের মধ্যে রাজনীতি শুরু করে। বারাউনিতে পূর্ব ভারতের তেল শোধনাগার তৈরি হয়।
★★ দার্জিলিঙে দেশের প্রথম পর্বতারোহণ শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা।
★★ কলকাতার পর হলদিয়া নদী বন্দর।এতেও ওনার হাত
★★ ফরাক্কা ব্যারাজ।তারও মূলে উনি।
★★ সত্যজিৎ রায়ের অসমাপ্ত ছবি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত ‘পথের পাঁচালী’ তিনি দেখেন এবং সরকারি নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে এই ছবিটির সরকারি প্রযোজনার ব্যবস্থা করেন।
★★ লালবাজার থেকে একবার পত্রপত্রিকা ও বাংলা বইয়ে আপত্তিকর অংশ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা শুরু হয় । বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধ সান্যাল ইত্যাদি পুলিশের বিষনজরে পড়ে গিয়েছেন বলে গুজব রটল। এঁরা আতঙ্কিত হয়ে তারাশঙ্কর ও সজনীকান্ত দাসকে ধরলেন, তারপর লেখকরা দলবদ্ধ হয়ে ডাক্তার রায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।বিধানচন্দ্র বললেন, তাই নাকি, এটা তো বড় অন্যায় ব্যাপার। রুনুকে ডাকো।হোম সেক্রেটারি আই সি এস রুনু গুপ্ত আসতেই ডা. রায় বললেন, এ কি সব তুঘলকি কাণ্ড। বিখ্যাত লেখকদের বই পুলিশ বাজেয়াপ্ত করছে, অ্যারেস্টের ভয় দেখাচ্ছে।আই সি এস রুনুর নিবেদন, আইনের ধারা অনুযায়ী পুলিশ কাজ করছে।বিধান রায় তাঁকে পাত্তা না দিয়ে বললেন, ওসব আইনটাইন কী আছে দেখে পাল্টাতে বলো। এঁদের অসম্মান করে এবং চটিয়ে সরকার চালানো যায়?তারাশঙ্কর ও অন্যান্য লেখকদের নিশ্চিন্ত করে তিনি জানালেন, আমি বলে দিচ্ছি, পুলিশ আপনাদের আর বিরক্ত করবে না।
★★ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বাড়িতে বিনা পয়সায় নিয়মিত রোগী দেখতেন সকাল সাতটায়। এবং তার জন্য দু’জন ডাক্তারকে নিজের পয়সায় নিয়োগ করেছিলেন। ব্যক্তিগত স্টাফের মাইনে দিতেন নিজের পকেট থেকে।
★★ গাঁধীজির সঙ্গে বিধান চন্দ্রের দারুণ হৃদ্যতা ছিল। তো একবার গান্ধীজী বিধান বাবুকে বললেন “আপনি যুক্ত প্রদেশের (এখন উত্তরপ্রদেশ) গভর্নরের পদগ্রহণ করতে রাজি হলেন না। আমি ভেবেছিলাম, আপনাকে ‘ইওর এক্সেলেন্সি’ বলে ডাকার সুযোগ পাব। তা হতে দিলেন না!” বিধানবাবুর উত্তরটি এক্ষেত্রে স্মরণীয়, ‘‘আমি আপনাকে আরও ভাল বিকল্প দিতে পারি। আমি পদবীতে রয়, তাই আপনি আমাকে রয়্যাল বলতে পারেন। আর যে হেতু অনেকের চেয়ে লম্বা, সে হেতু আপনি আমাকে রয়্যাল হাইনেস বলতে পারেন! সেটা কিন্তু যথার্থই হবে।
★★ ঠাকুমা আদর করে নাম রেখেছিলেন ভজন। আর তাঁর ভাল নাম রাখার দিনে হাজির ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন (সেই কেশব সেন যিনি বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি)।
★★ পাঁচ টাকা ২৫ পয়সা নিয়ে যিনি কলকাতা শহরে এসেছিলেন। তাঁর তিরোধানের পর মূখ্যমন্ত্রীর ঘরে পাওয়া যায় ১১ টাকা ২৫ পয়সা। কুঁড়েঘর থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত জীবনের সঞ্চয় ছিল মোট ৬ টাকা আর কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা। এই না হলে সত্যিকারের মানুষের হৃদয়ের জননেতা।