জানবাজারের জমিদার রাজচন্দ্র দাসের সঙ্গে খুব অল্প বয়সে বিবাহ হয় এক অখ্যাত পরিবারের রাসমণির। ৪৩ বছর বয়সে স্বামীর মৃত্যুর পর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ওঅপর। রানি রাসমণি ছিলেন প্রজা বৎসল, ঈশ্বর-বিশ্বাসী। কাশীতে বিশ্বনাথ ও অন্নপূর্ণা দর্শনে যাওয়ার পূর্ব রাত্রে স্বপ্নে নির্দেশ পান গঙ্গা তীরে মন্দির নির্মাণ করে দেবী প্রতিষ্ঠা করার।
হালিশহরের ব্রাহ্মণ ও জমির মালিকরা নিচু জাতির মেয়ের এই উদ্যোগকে সমর্থন না করায় শেষ পর্যন্ত অনেক খুঁজে দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গার ধারে একটি জায়গা পছন্দ করেন। ১৮৪৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ইংরেজদের থেকে কিনে নেন মুসলিম কবরখানা ও ইংরেজদের পরিত্যক্ত কুঠিসহ ৬০ বিঘা জমি। শুরু হয় মন্দির নির্মাণ কাজ। শেষ পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হলে ১৮৫৫ সালের ৩১ মে মন্দির উদ্বোধন ও দেবী কালিকার প্রতিষ্ঠা হয়।
সমস্যা শুরু হয় তারপর। নিম্ন বংশোদ্ভূত মহিলাকে প্রতিদিন দেবীর অন্নভোগ দানের অধিকার দেওয়ার ব্যাপারে বেঁকে বসেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা। শেষে রানির একান্ত অনুরোধে পণ্ডিত রামকুমার চট্টোপাধ্যায় (রামকৃষ্ণের দাদা) মন্দিরের পূজারীর দায়িত্ব নেন।
ভবতারিণী মন্দিরের একটি গঠন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি একটি নবরত্ন মন্দির। প্রথম ধাপে অর্থাৎ নিচের থাকে চারটি, দ্বিতীয় ধাপে অর্থাৎ মাঝের থাকে চারটি এবং সবার উপরে একটি চূড়া রয়েছে। মন্দিরের ছাদটির আকার ধনুকের মতো। সামনে রয়েছে নাট মন্দির। নাটমন্দিরের ওপরে মহাদেব, নান্দী ও ভৃঙ্গির মূর্তি আছে। মন্দিরের উত্তরে আছে শ্রী শ্রী রাধাকান্তের মন্দির।
পশ্চিমে আছে ১২ টি শিব মন্দির। মাঝে আছে বিস্তৃত প্রাঙ্গণ, যার উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেবের শোয়ার ঘর।
দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণদেবের লীলাক্ষেত্র। ছোটবেলায় দাদা রামকুমারের সঙ্গে প্রায়ই দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে আসলেও ২১ বছর বয়সেই তিনি এই মন্দিরে পূজার কাজে নিযুক্ত হন।
পরমহংস রামকৃষ্ণ দেবীকে যে শুধু দেখেছেন তাই নয়, কখনো শিশুর মতো আব্দার করেছেন, কখনো মাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছেন। বহু ভক্তজন এখানে দেবী ভবতারিণীর জাগ্রত রূপের পরিচয় পেয়েছেন। স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন রানি রাসমণিও। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ এখানে আসেন মায়ের আশীর্বাদ ও শান্তি লাভের আশায়।
হুগলি জেলার শেওড়াফুলির নাম তখন ছিল সাড়াপুলি। কাটোয়ার পাটুলির জমিদার মনোহর দত্ত ভিটেমাটি ছেড়ে এক সময় সপরিবারে চলে আসেন সাড়াপুলিতে। কারণ, নদী ভাঙনে তাঁর বাড়ি-ঘর, জমিদারি— সবই ভেসে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি ‘রায়’ উপাধি পান, সঙ্গে ‘রাজা’র খেতাবও অর্জন করেন। তাঁরই প্রপৌত্র রাজা হরিশ্চন্দ্র রায়, ভাগিরথীর তীরে নির্মাণ করেছিলেন নিস্তারিণী দেবীর মন্দির।
কথিত, এই নিস্তারিণী মন্দিরের মাতৃমূর্তির আদলেই পরবর্তীকালে ভবতারিণী মূর্তি স্থাপন করা হয় দক্ষিণেশ্বরে। ‘নিছক গল্প নয়, এ কাহিনি একেবারেই সত্যি ঘটনা’, বললেন বর্তমান প্রজন্মের আশিস ঘোষ।
১৮৮৪ সালে রামকৃষ্ণ পরমহংস নরেন্দ্রনাথ দত্তকে (স্বামী বিবেকানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম)দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে আর্থিক উন্নতির জন্য প্রার্থনা করতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত শুদ্ধ জ্ঞান, ভক্তি ও বৈরাগ্য প্রার্থনা করেন।
আর্থিক সমস্যা দূর করার উদ্দেশ্যে তিন বার কালীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে গিয়ে তিন বারই নরেন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছিলেন: “মা, জ্ঞান ও ভক্তি ছাড়া আর কিছুই আমি চাই না।”
বিবেকানন্দের জীবনের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ, বিবেকানন্দ প্রথম দিকে প্রতিমা পূজার বিরোধী হলেও, এই ঘটনার পর থেকে তিনি কালীমূর্তি পূজা মেনে নেন এবং কালীমূর্তির কাছে প্রার্থনা করেন। “এই ঘটনা নরেন্দ্রের ভক্তি ও জ্ঞানে নতুন মাত্রা যোগ করে।”